• বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫, ১১:০৯ অপরাহ্ন

গল্প : খোলা চিঠি :::: নুরুল ইসলাম নূরচান

admin / ১১৭ Time View
Update : শুক্রবার, ১০ মে, ২০২৪

গল্প : খোলা চিঠি

নুরুল ইসলাম নূরচান

আমি মনস্থির করেছি একটি খোলা চিঠি লিখব। এজন্য একবার আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়ি, আবার ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠি। কাগজকলম হাতে নিয়েও চিন্তামগ্ন হই, কি জানি, এই খোলা চিঠিতে যদি আবার হিতে বিপরীত হয়! আমার প্রিয় বস্তুগুলো যদি আবার আমার সাথে মহা রাগ করে বসে!

মনকে খুব শক্ত করে পুনরায় কাগজ কলম হাতে নিলাম। এই ভেবে মনকে প্রবোধ দেই যে, চিঠি পেয়ে তারা মহা রাগ হবেন না, যৎকিঞ্চিত রাগ হতে পারে, এই রাগ তাদের সাথে সাক্ষাৎ করে ভাঙাতে পারবো। কারণ সব দোষ তাদের একার নয়, আমদানি শুল্ক বৃদ্ধির জন্য তাদের মেজাজ অনেকটাই গরম।

আমি একটি ফুলস্ক্রিপ কাগজ হাতে নিয়ে তার তিনদিকে পর্যাপ্ত পরিমাণ মার্জিন রেখে লেখা শুরু করলাম-,

প্রিয় গরু, খাসি, মহিষ, ভেড়া
তোমরা প্রথমে আমার শুভেচ্ছা নিও,
আমি আশা করি, তোমরা সকলেই ভালো আছো, প্রত্যাশা ও করি তাই। তোমরা ভালো থাকলে আমিও ভালো থাকি, তোমাদের দুঃখে আমি দুঃখিত হই। তোমাদের সাথে মাঝেমধ্যে দেখা হয়, কিন্তু কথা হয়না। তোমাদের দিনকাল কেমন চলছে- তাও জানা হয় না।
সময়ের অভাবে তোমাদের খোঁজখবর নিতে পারি না, আসলে দিনদিন আমি যেন যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছি, তোমাদের এত কাছে থেকেও কোন খোঁজখবর না নেওয়াটা আমার চরম ব্যর্থতা। যাহোক তোমাদের উদ্দেশ্যে দু চারটি কথা বলি, আশা করি আমার প্রতি রাগ করবে না।

এইবার আসল কথায় আসি। তোমাদের সাথে প্রায় প্রতিদিন দেখা হলেও তোমাদের মাংসের সাথে কোন কথা হয় না। গত এক বছর আগে প্রিয় গরুর মাংসের সাথে কথা ও মাখামাখি হয়েছিল। সেটি কুরবানির ঈদ উপলক্ষে। ‘গাঁওয়ালা বন্ডক’ এর মাধ্যমে কিছু মাংস পেয়েছিলাম। সেই মাংস বৃদ্ধ মা-বাবাকে নিয়ে মোটামুটি তৃপ্তি সহকারে খেয়েছিলাম। কুরবানির ঈদ আর ক’ মাস পরেই। আশা করি আবার গরু এবং খাসির মাংসের সাথে সাক্ষাৎ হবে। অবশ্য কয়েকদিন পর রোজার ঈদ। রোজার ঈদে তোমাদের সাথে আমাদের মত লোকজনের সাক্ষাৎ হওয়ার কথা নয়।

প্রিয় গরু-খাসি
তোমার মাংস নিয়ে দেশে পড়ে গিয়েছে কাড়াকাড়ি, একরকম মারামারিও বলা চলে। আর এই জন্যই আমাদের সরকার বাহাদুর তোমাদের মাংসের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছেন ১,০০০-৯০০, ৭৫০ এর স্থলে ৬০০ টাকা। তবে ব্যবসায়ীরা সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি করতে রাজি নয়, ফলে ভোক্তা এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে রীতিমতো চরম দ্বন্দ্ব বিরাজ করছে। শুধু তোমাদের মাংসের দাম নিয়ে যে দ্বন্দ্ব চলছে তা নয়, আরো কিছু পণ্যের দাম বেঁধে দিয়েছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। আর কোনদিন কাজ হবে বলেও মনে হচ্ছে না। আহারে, আমার সোনার বাংলা! অথচ এই দেশটা পাকিস্তান থেকে আলাদা করতে দেশের কত রক্ত, কত মা বোনের ইজ্জত ক্ষয় হয়েছিল।

প্রিয় গরু
তোমার মাংসের জন্য আফসোস করতে করতে আমার বৃদ্ধ মা-বাবা ওপারে চলে গেছেন। এত দামের কারণে আমি তোমার মাংসের কাছে যেতেই পারিনি। তাদের ওষুধপথ্য এবং ভরণপোষণ দিতেই আমি হিমশিম খেতাম। এখন তোমার মাংসের কথা মনে পড়লে মা বাবার কবরের পাশে গিয়ে নিরবে কাঁদি। এদিকে আমার জীবনমানের অনেক উন্নতি হয়েছে। মা-বাবা থাকতে অন্যের জায়গায় একটি ডেরাঘরে বসবাস করতাম। এখন বসবাস করি ইস্টিশনে।

প্রিয় গরু
তোমাকে বলা আমার এসব কথা যেন কেউ না জানে। আমার এ কথা মানুষ জানতে পারলে আমাকে পেটুক মনে করবে। এখন তো আর মানুষ মানুষ নেই, অন্যের কাটা ঘায়ে ওষুধ না দিয়ে লবণ ছিঁটিয়ে দেয়। তাছাড়া যদি দেশের নীতিনির্ধারকরা জানতে পারে তাহলে আমার ফাঁসিও হতে পারে।

প্রিয় সকল নিত্যপণ্য
তোমাদেরকে সালাম। আশা করি তোমরা খুব ভালো আছো। তোমাদের দোয়ায় আমিও মোটামুটি ভালো।
পর সমাচার এই যে, আমার অনেক ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা থাকার পরও তোমাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করতে পারছি না, এটা আমার চরম ব্যর্থতা। কী করবো বলো! আমি রোজগার করি সামান্য টাকা। তোমাদের দাম আকাশ ছোঁয়া। তাই তোমাদের সাথে নিয়মিত দেখা করতে পারছি না, এজন্য মনে কোন কষ্ট নিও না, আমার ব্যর্থতার জন্য তোমাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আমার এ সামান্য ইনকামের টাকা দিয়ে তোমাদের মন খুশি করতে পারব না বলে দেখা করি না। তাছাড়া তোমাদের চাহিদা পূরণ করতে পারিনি বলে এখন আমি নতুন কৌশলে রান্না করে খাচ্ছি।

নতুন রান্না করার কৌশল আমি তোমাদেরকে এখন বলবো।
কৌশলটি হলো-
চালের সাথে পরিমাণ মতো পানি দিয়ে হাঁড়ি চুলায় চড়াই। ভাত সেদ্ধ হওয়ার পর তাতে কিছু লবণ এবং সামান্য হলুদ ঢেলে দেই। ভাতের ফেন (মাড়) গালি না। ফলে খিচুড়ির মতো হয়ে যায়। পরে তা একটু গরম গরম খেয়ে ফেলি। এতে পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ, তেল এবং মাছ সবজি সবই বাঁচে। তোমাদের কাছে জোর হাত করে মিনতি করি, আমার খোলা চিঠি পেয়ে তোমরা মন খারাপ করোনা। তোমাদের ঝাঁজ কমলে, মেজাজ ঠান্ডা হলে পুনরায় তোমাদের সাথে সাক্ষাৎ হতে পারে।

গরুর মাংসের জন্য আফসোস করতে করতে মারা যাওয়া বৃদ্ধ মা বাবার কথা মনে পড়ায় আমার দুটি চোখ ভিজে যায়। ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে আর লিখতে পারছি না। তোমরা সবাই ভালো থেকো, তোমাদের জন্য অনেক অনেক শুভ কামনা রইল।
ইতি-
তোমাদের একসময়ের আপনজন
মজনু মিয়া।

লেখক: কবি ও সাহিত্যিক
রচনাকাল : মার্চ ২০২৪


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category