গল্প : বকুলতলা
নূরুল ইসলাম নূরচান
আজ ছবির বিয়ে। অবশ্য বিয়েতে রাজি ছিল না সে। তারপরও তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হচ্ছে। অভিভাবকের ইচ্ছায় তাকে বিয়ে করতে হচ্ছে। এ ছাড়া আর কোন উপায় নেই তার। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান সে। এইচএসসি পাস করার পর আরো পড়াশোনা করে চাকরি বাকরি করার ইচ্ছে ছিল তার। কিন্তু তার সেই ইচ্ছা আর পূরণ হলো না। ছবি এ পর্যন্ত পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন একরকম সংগ্রাম করে। অর্থনৈতিক টানাপড়েনের পাশাপাশি নানা ঘাত প্রতিঘাত লেগে ছিল সবসময়ই।
জন্মগ্রহণ করার পর তার চেহারা দেখে সবাই অবাক। কোনো মানুষের চেহারা এত সুন্দর হতে পারে- তার পরিবারের তা আগে জানা ছিল না। তাকে দেখতে অবিকল ‘ছবির’ মতো। তাই তার নাম রাখা হয় ‘ছবি।’ সে যখন ক্লাস ফোর ফাইভে পড়ে তখনই দুষ্টু ছেলেদের নজর পড়ে তার ওপর। স্কুলে আসা যাওয়ার সময় নীরব ইভটিজিং এর শিকার হতে থাকে সে। তারপরও দমে থাকে নি ছবি। দুষ্টু ছেলেদেরকে কোন পাত্তা না দিয়ে সে তার পড়াশোনা চালিয়ে গেছে। সে কখনো শালীনতা বিবর্জিত কোন পোশাক পরিধান করেনি, এমন কি মুখে কোন মেকআপও লাগান নি। তার পরও তার পেছনে প্রায় সব ছেলেরাই লেগে থাকতো। তবে কোন ছেলেই তার কাছে পাত্তা পায়নি কোনদিন। ছবির মনে দৃঢ় প্রত্যয় ছিল যে, ‘ভালোভাবে পড়াশোনা করে আমাকে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।’
অন্য দশটা মেয়ের মত তার মনেও প্রেম ভালবাসা জেগেছিল। কিন্তু তার ফ্যামিলির ইজ্জতের কথা চিন্তা করে সে কখনো সেদিকে পা বাড়ায়নি। যখনই কোন ছেলের প্রতি মন দুর্বল হয়েছে ঠিক তখনই নিজের মনকে নিজেই প্রবোধ দিয়েছে। তার মনের দুর্বলতার কথা কখনো কারো কাছে প্রকাশ করেনি। স্কুল- কলেজ জীবনে দুই একজন বাদে সকল শিক্ষকই তাকে অনেক স্নেহ করেছে। সে ও বাবা-মার পরে শিক্ষকদেরকে গুরুজন মনে করেছে।
ক্লাস এইট নাইনে পড়াকালীন সময় থেকেই নানাদিক থেকে তার বিয়ের সম্বন্ধ আসতে থাকে। অবস্থাটা এমন যে, তাকে ছাড়া যেন দেশে আর কোন মেয়ে নেই। ঘনঘন বিয়ের সম্বন্ধ আসতে থাকায় এক পর্যায়ে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েন তার অভিভাবক। তাই বাধ্য হয়ে একরকম দ্রুততার সাথে বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করা হয়। এছাড়াও আরো একটি উল্লেখযোগ্য কারণ আছে। একদিন তার বাবা তাকে ডেকে বলল, ‘শোন মা।’
‘বলো বাবা, কী বলবে?’
‘তোর পড়াশোনা এবং সংসারের খরচ মেটাতে গিয়ে আমি হিমশিম খাচ্ছি, গত ক বছরে ঋণগ্রস্ত হয়ে গেছি, বর্তমানে আমার আয়ের চেয়ে ব্যয় দু তিন গুণ বেশি হচ্ছে। এখন আমি কি করি তুই বল মা?’
‘আমাকে নিয়ে তোমাদের টেনশন করতে হবে না বাবা। মা এবং তুমি যা ভাল মনে কর তাই হবে। তোমরা কি সিদ্ধান্ত নিয়েছো, তা আমাকে জানাও!’
‘মা রে, কীভাবে যে তোকে কথাটা বলব তা ভেবে পাচ্ছি না।’
‘কোন সমস্যা নেই, তুমি আমাকে বন্ধুর মতো জানো, আমিও তোমাকে বন্ধুর মতই জানি। যা বলার খুলে বলতে পারো।’
‘আমরা তোর বিয়ের কথা ভাবছিলাম, তুই কি বলিস?’
‘তোমাদের সিদ্ধান্ত আমি মাথা পেতে নেব বাবা-‘ বলে হাসল ছবি। এরপর বাবার কাঁধে মাথা রাখলো ছোট শিশুর মত।
মেয়ের এমন কাণ্ডে বাবার দুচোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। এ অশ্রু আনন্দ না বেদনার, তা বোঝা গেল না।
বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে ছবি চলে গেল তার স্বামী বাড়িতে।
স্বামী বাড়িতে ছবির দিন ভালই কাটছিল। আগে কেউ জানতে না পারলেও বিয়ের কিছুদিন পরই তার স্বামীর দুটি ঘটনার কথা সে জেনে ফেলেছে। আদতে কিছু মানুষের কথা কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা-তা বলা দুষ্কর। ছবির স্বামীর বেলায় তেমনটিই ঘটেছে। এসব ঘটনা জানার পর স্বামীর প্রতি অনেকটাই বিরক্ত ছবি। সে খুব বুদ্ধিমতি হওয়ার কারণে স্বামীকে তার অসন্তুষ্টির কথা বুঝতে দেয়নি, আচার-আচরণ কিংবা কথায় তার দুঃখ কষ্টের কথা প্রকাশ পায়নি।
বিয়ের পর থেকে স্বামী আকিবও খুব আদর, স্নেহ ও ভালোবাসা দিয়ে আঁকড়ে রেখেছেন স্ত্রীকে। ‘মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির’ মতো অবস্থা। মানে ছবি কোন কিছু চাওয়ার আগেই প্রয়োজনীয় সবকিছু বাসায় হাজির।
একদিন আকিব অফিস শেষে বাসায় ফিরলো। রাতে খাবার দাবার শেষে পাশাপাশি বসে গল্প করছিল স্বামী-স্ত্রী।
নরম স্বরে ছবি বলল, আচ্ছা আকিব তুমি আমার পরিবার এবং আমার সাথে মিথ্যের আশ্রয় নিলে কেন?
-কি রকম? কিছুটা বিস্মিত আকিব।
-তোমার চাচার দোতলা বাড়িকে তোমার বলেছিলে কেন?
-আমার তেমন কোনো ভালো ঘরবাড়ি ছিল না, তাই।
-তাই বলে অন্যজনের ঘরকে তোমার ঘর বলতে হবে!
-এছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিল না।
-মানছি। কিন্তু তুমি চাকরি করো অফিস সহায়ক পদে, অথচ তুমি বলেছিলে, কর্মকর্তা পদে চাকরি করো। এত বড় মিথ্যে বলার কী দরকার ছিল!
স্ত্রীর মুখে এসব কথা শুনে আকিব খুবই লজ্জিত এবং অপরাধী মনে করছেন নিজেকে।
সে নিচু গলায় বলল,
আমি যদি মিথ্যার আশ্রয় না নিতাম তাহলে তোমার অভিভাবক তোমাকে আমার কাছে বিয়ে দেওয়ার জন্য কোনদিনই রাজি হতেন না। কিন্তু তুমি এসব জানলে কী করে?
-একটা সত্যকে হাজারটা মিথ্যে দিয়েও ঢেকে রাখা যায় না, সত্যটা একদিন অবশ্যই প্রকাশ হয়। একদিন তোমার চাচি বলেছিল, ‘আকিব তোর বউ এখন পুরনো হয়ে গেছে, সে এখনো আসল খবরটা জানেনা। এখন তুই একটি বাসা ভাড়া নিয়ে সেখানে ওঠ।’
এ কথাটা আমি আড়ালে থেকে শুনেছিলাম। কিন্তু তোমাদের কাউকে বুঝতে দেইনি।
ছবি একটু দম নিয়ে পুনরায় বললো, একদিন তোমাদের অফিসের কাছ দিয়ে যাচ্ছিলাম। তখন দু তিনজন বলাবলি করছিল, ‘এই দ্যাখ আমাদের অফিসের পিয়ন আকিবের বউ যাচ্ছে!’
-আমি একদিন তোমাদের কলেজে গিয়েছিলাম। সেদিনই আমি তোমাকে প্রথম দেখি। দেখার পর থেকেই আমি তোমার প্রতি দুর্বল হয়ে গিয়েছিলাম, মনে মনে স্থির করেছিলাম যে,বিয়ে যদি করি তাহলে তোমাকেই করব। এর কিছুদিন পরই তোমাদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলাম।
খুবই বিনয়ের সাথে কথাগুলো বললেন আকিব। এই মুহূর্তে তার মনে প্রচন্ড একটি ভয় কাজ করছে। ছবি সবকিছু জেনে ফেলেছে, এখন যদি তাকে ত্যাগ করে সে চলে যায় তাহলে আকিবের জীবনটা ছন্নড়া পাখির মতো হয়ে যাবে।
স্ত্রীকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলো সে। ছবির মধ্যে কঠোর কোন মনোভাব দেখতে পেলোনা, তাই একদম কাছাকাছি গিয়ে বসে দুটি হাত চেপে ধরলো। বললো,
-লক্ষ্মী আমার, তুমি আমাকে ভুল বুঝনা, আমাকে ক্ষমা করে দাও, আমি যা করেছি তোমাকে কাছে পাওয়ার জন্যই করেছি।
-ঠিক আছে জনাব, আমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার দরকার নেই, আমার মা-বাবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ো, তারা খুব কষ্ট পেয়েছেন। রাত অনেক হয়েছে, এখন ঘুমাও।
সকালে আকিব নাস্তা সেরে অফিসে চলে গেলো। যাওয়ার সময় ছবিকে বলে গেলো, ইদানিং বিভিন্ন বাসাবাড়িতে চুরি ডাকাতি হচ্ছে। সাবধানে থেকো, নিজের প্রতি খেয়াল রেখো। কোন সমস্যা হলে আমাকে কল দিয়ো, ওকে বাই!
-বাই,তুমিও কোন টেনশন করো না, সাবধানে যেও।
বলে হাত নাড়লো ছবি।
কড়া নাড়ার শব্দ শুনে দরজা খুলে অবাক ছবি। আকিবের হাতে তিন চারটি শপিং ব্যাগ, সাথে কাঁচা বাজারের ব্যাগ ও আছে।
হাসতে হাসতে বাসার ভেতরে ঢুকলো আকিব। কিন্তু ছবির মুখে কোন হাসি নেই। তার মধ্যে গম্ভীর ভাব। স্বামীর হাত থেকে ব্যাগগুলো নিয়ে খাটের ওপর রাখলেন ছবি। কাঁচা বাজারের ব্যাগের ভেতর ইয়া বড় দুটি রুই-কাতল মাছ।
ব্যাগগুলো রেখে টিপকলপাড় ঢুকলো আকিব। হাতমুখ ধুয়ে ফিরে এসে দেখে ছবি মন ভারী করে বসে রয়েছে ঠাঁয়।
-কী ব্যাপার তোমার কি মন খারাপ?
-কেন?
-এভাবে মুখ গোমরা করে বসে আছো যে!
-এমনি। আচ্ছা আকিব তুমি তো বেতন পাও মাসের চার পাঁচ তারিখে, তাই না?
-হুম।
-তো আজ তো মাসের পঁচিশ তারিখ, তুমি এতো টাকা কোথায় পেলে, কীভাবে এতো শপিং এবং বড়ো মাছ কিনলে!
-তুমি আমার কাছে বসো, আমি সবকিছু বলছি।
-বলো।
-একজনের একটি কাজ কন্ট্রাক্ট নিয়েছিলাম বিশ হাজার টাকা, কাজটি নিয়েছিলাম এক সপ্তাহ আগে। আজ বসকে দিয়ে কাজটি কমপ্লিট করিয়েছি। কাজ কমপ্লিট করে দেওয়ার পর সেই ভদ্রলোক বিশ হাজার টাকার নগদ দিয়েছেন, বসকে দশ হাজার টাকা দিয়ে বাকি দশ হাজার টাকা আমি পেয়েছি। সেই টাকা দিয়ে তোমার জন্য দুটি থ্রি পিস এবং একটি শাড়ি কিনেছি।
-শোনো আকিব, অনৈতিকভাবে তোমার উপরী উপার্জনের আমার প্রয়োজন নেই, তোমার বেতনের টাকায় যেটুকু খেতে পরতে পারছি, তাতেই আমি সন্তুষ্ট। তুমি আর কোনদিনও এ ধরণের কাজ করবে না।
-কিন্তু–
-কোন কিন্তু নেই।
-ছবি তুমি বুঝতে চেষ্টা করো, আমি কোন অনৈতিক কাজ করি না।
-আমি ভালো করেই জানি, কেউ বিপদে না পড়লে কাউকে এমনি এমনি টাকা পয়সা দেয় না। কারো ফাইলপত্র আটকিয়ে টাকা পয়সার ধান্দা করা মানেই অনৈতিক কাজ। বিপদে ফেলে কারো পকেটের টাকা এনে বিলাসিতা করার কোন অর্থ নেই।
-ঠিক আছে তোমার হাত ধরে আমি কথা দিলাম, আর কোনদিন এ ধরনের কাজ করবো না। লক্ষ্মী মেয়ের মত এবার একটু হাসো!
প্রাণ খুলে হাসলো ছবি। বললো, তুমি যে ভদ্রলোকের কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলে তার কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে নেবে।
-ওকে।
-শোন আকিব, এ কাপড়চোপড়গুলো কোন অসহায় মানুষকে দিয়ে দেবো। সাথে কাপড়ও। ঘরে যে কাপড় আছে সেগুলোতেই আমার চলবে।
-ঠিক আছে, তুমি যা বলবে তাই হবে।
-আকিব তুমি ডাইনিং টেবিলে যাও, আমি খাবার রেডি করে নিয়ে আসছি- বলে ছবি চলে গেল কিচেন রুমে।
খাবার-দাবার পর্ব শেষ করে তারা চলে গেল বেডরুমে।
আজ শুক্রবার, সাপ্তাহিক ছুটির দিন। ছবি বললো, অনেকদিন যাবত বাবা-মার সাথে দেখা হচ্ছে না।
আকিব বললেন, তবে চলো ঘুরে আসি?
-ঠিক আছে।
অনেকদিন পর মেয়ে-জামাই আসায় খুব খুশি হয়েছেন ছবির মা-বাবা।
সামর্থ্য অনুযায়ী আপ্যায়ন করেছেন মেয়ে জামাইকে। অর্থকড়ির টানাটানি থাকলে আত্মীয়-স্বজনকে আদর আপ্যায়ন তেমন একটা করা যায় না। ছবির বাবা তাই আফসোস করে বলেন, ‘কেন যে মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নিয়েছিলাম! সাধ আছে তো সাধ্য নেই।’
ছবির বাবা বর্তমানে অবসরে আছেন। আগে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করতেন।
ছবির একটি মাত্র ভাই। সে টাকা পয়সা একটু বেশি খরচ করে বলে অভিযোগ তার বাবার। বাজার থেকে তার বাবা যে জিনিসটি ১০০ টাকায় ক্রয় করে আনতে পারেন সেটাই তার ছেলে ১২০-৩০ টাকা দিয়ে আনেন।
হাসতে হাসতে একদিন ছেলেকে বললেন, ‘আচ্ছা তুই বাজার করতে গেলে টাকা এত বেশি খরচ হয় কেন, একটু জিনিসপত্র একটু মুলামুলি করে ক্রয় করতে পারিস না?
হাসতে হাসতে ছেলে জবাব করে, ‘তোমার বাবা তো ছিল দুস্তর কৃষক, তাই তোমার মত এত পরিচিতি ছিল না। আমি বাজারে গেলেই অনেকে বলেন, ‘এই যে কলিম সাহেবের ছেলে এসেছে!’
-বাবা আমি তো আমার ইজ্জতের কথা চিন্তা করি না, তোমার ইজ্জত বাঁচাতে গিয়েই আমাকে জিনিসপত্রের দাম একটু বেশি দিতে হয়।
-হুম, বুঝি, এখন তো ইজ্জত ধুয়ে জল খাওয়ার যোগাড় হয়েছে। কিছুক্ষণের জন্য ভাবনার জগতে ঢুকে পরেন কলিমউদ্দিন। আবার পরক্ষণেই এসব নিয়ে হাসাহাসি করেন বাবা ছেলে।
কলিমউদ্দিন ছেলে, মেয়ে-জামাই এবং স্ত্রীকে ডেকে এক সাথে করেছেন। সবাই পাশাপাশি। ছেলে মেয়েকে উদ্দেশ্য করে কলিমউদ্দিন বললেন,
-আরিফ ছবি তোমারা শোন, আমার বয়স হয়েছে। আমার আগে পরের অনেকেই নেই, কখন বিদায় নিতে হয় তা বলতে পারিনা। পৃথিবীতে আসার সিরিয়াল আছে কিন্তু যাওয়ার সিরিয়াল নেই, যে কেউ যেকোন সময় চলে যেতে পারেন। তবে যাদের বয়স হয়ে যায় তাদের আশা খুবই ক্ষীণ। তাছাড়া রোগ শোকে একেবারে নাস্তানাবুদ হয়ে গেছি, অন্যান্য জিনিসপত্রের সাথে ওষুধের দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে ওষুধ খাওয়াও দুরূহ হয়ে পড়েছে।
-এসব বলো না বাবা, তোমাকে আমরা হারাতে চাই না- ছবির কণ্ঠ ভেজা।
-তুমি ভেঙ্গে পড়োনা বাবা- আরিফ বলেন। কি এমন বয়স হয়েছে, বড়জোর সত্তর।
-যাইহোক আমার একটি শেষ ইচ্ছা তোমাদেরকে জানিয়ে রাখি।
-বলো বাবা, বাবার শেষ ইচ্ছের কথা জানার জন্য ছবি খুবই আগ্রহী উঠলো।
-আমি মারা গেলে আমাদের বাড়ির পাশের বকুল গাছটার নিকট কবর দিয়ো। এটাই আমার শেষ ইচ্ছে।
-আমারও ঠিক একই ইচ্ছে, তোদের বাবার কবরের পাশে আমাকেও কবর দিস, এতক্ষণ ধরে চুপ করে থাকা ছবির মা’র গলা।
-ঠিক আছে তোমাদের শেষ ইচ্ছা পূরণ হবে, আরিফের রাশভারী কণ্ঠ।
কথা শেষ করে আরিফ চলে গেল।
ছবি মা বাবাকে ডেকে বলল, মা-বাবা তোমাদের জামাই যেন কী বলবে, একটু মনোযোগ দিয়ে শোনো তোমরা।
-বিয়ের আগে আমার কিছু মিথ্যে কথার জন্য আমি আপনাদের কাছে ক্ষমা চাচ্ছি, নিজের সন্তান মনে করে আমাকে ক্ষমা করে দিন প্লিজ! বলে শ্বশুরের হাত চেপে ধরল আকিব।
-ঠিক আছে। তোমরা সুখী হলেই আমরা সুখী- কলিমউদ্দিন বললেন।
ইংরেজি ‘ই’ প্যাটানে একতলা বিশিষ্ট বাড়ি কলিমউদ্দিনের। এক বিঘা জমির উপর বাড়িটিতে চর্তুর দিকে সারি সারি নারকেল, সুপারি, আম, জাম লিচুসহ বেশ কিছু ফল গাছ রয়েছে। এছাড়া হাসনাহেনা, বেলি, গোলাপের পাশাপাশি দেবদারু গাছও রয়েছে। লিচু গাছটার নিচে ইট-সিমেন্টে বেঞ্চি, বেঞ্চিতে সুন্দর টাইলস বসানো। এই বেঞ্চিতে বসেই বুড়ো বুড়ি গল্প করে সময় কাটান।
দুপুরে খানাপিনা সেরে সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল ছবি ও তার স্বামী।
আকিবের কাছে তাদের মেয়ে বেশ সুখে আছে জেনে সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া আদায় করলেন বুড়ো বুড়ি।
বিয়ের পরে মেয়েরা যদি স্বামীর বাড়িতে সুখী না হয় তাহলে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পায় মা বাবা। কারণ মেয়েদের শেষ ঠিকানা স্বামীবাড়ি। সেখানে কোন ঝুট ঝামেলা হলে মেয়েদের দুঃখের আর শেষ থাকে না। সকল মা-বাবাই ছেলেদের চেয়ে বেশি যত্ন করে লালন পালন করেন মেয়েদেরকে। ভালো কোন খাবার বাবা-মা নিজে না খেয়ে মেয়েকে খাওয়ান, কারো কারো ধারণা-স্বামী সংসারে গিয়ে যদি মেয়ে ভালো কিছু খেতে না পারে তাহলে সে খুব কষ্ট পাবে।
একটি অস্ত্রোপচারের জন্য ভারতে চলে গেছেন আকিব ও তার স্ত্রী। সেখানে ছবির অপারেশন হয়েছে। তাদের থাকতে হবে কমপক্ষে এক মাস।
এদিকে এক সপ্তাহের ব্যবধানে কলিমউদ্দিন ও তার স্ত্রী পরলোকগত হলেন।
এ সংবাদ আকিবরা পেয়েছেন। কিন্তু দেশে আসতে পারেননি। এক মাস পর ছবি সুস্থ হয়ে স্বামীর সাথে দেশে চলে আসলেন। এসে সোজা চলে গেলেন বাবার বাড়ি। গিয়ে দেখন, বাবা-মার কবর বকুলতলায় নেই। তাহলে মা-বাবাকে কোথায় কবর দেয়া হলো! ছবি তার ভাইকে খুঁজচ্ছে। কিন্তু কোথাও পাচ্ছে না। তার বাবার ঘরের দরজায় বড় একটি তালা ঝুলছে। পরে লোক মুখে জানতে পারল, বাড়ির জায়গাটি অনেক দামি, তাছাড়া এখানে তাদেরকে কবর দিলে বাড়ির সৌন্দর্য নষ্ট হবে-এসব ভেবে, মা-বাবার শেষ ইচ্ছে পূরণ না করে তাদেরকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করেছেন আরিফ।
পারিবারিক কবরস্থানে গিয়ে মা-বাবার কবর খুঁচ্ছেন ছবি।
লেখক:: কবি ও সাহিত্যিক.