ঈদের পাঞ্জাবী
নূরুদ্দীন দরজী
কয়েক বছর পূর্বের কথা। রোজা শুরু হওয়ার কয়েকদিন বাকি। ছেলে বললো তাড়াতাড়ি ঢাকায় চলে যেতে। এ বছর আগে ভাগেই জামা কাপড় কিনে ফেলতে হবে। আমি বললাম,আমাকে টাকা দিয়ে দিতে। উপজেলা সদর শিবপুর থেকেই একটি পাঞ্জাবী কিনবো। ছেলে রাজি হলো না। বললো ” আপনি ভালো পাঞ্জাবী কিনতে পারবে না, আপনার জন্য একটি দামী পাঞ্জাবী কিনতে হবে। জানি আমার কথায় কাজ হবে না- তাই আর কথা বাড়ালাম না।
রোজা শুরু হওয়ার ১/২ দিন আগে অফিস থেকে একটু আগে আগে বের হয়ে সোজা চলে যাই ঢাকার মতিঝিলে। ঐ দিন ছেলের মতিঝিলে ব্যাংকে কাজ ছিলে। বাপ বেটা একত্রিত হলাম। জোহর নামাজ পড়ে একটি হোটেলে খেতে বসেছি। খেতে খেতে বললাম, ” তোমার কথায় ঢাকা এলাম পাঞ্চাবী কিনতে। কিন্তু আমার একটি শর্ত আছে। সচকিত হয়ে ছেলে জানতে চাইলো, কি শর্ত ? বললাম,” তোমার পছন্দ মত, যেটি ভালো মনে করবে সেটিই আমি কিনতে রাজী আছি। কিন্তু পাঞ্চাবীর দোকানে যেয়ে তোমার পছন্দের পর দোকানদার সাথে দামাদামী করবো আমি। অর্থাৎ দোকানদার যে দাম চাইবে তার বিপরীতে তুমি কিছু বলতে পারবে না। আমার পছন্দ মত দাম আমি বলবো। স্বচ্ছন্দে না হলেও আমার শর্তটি মেনে নিতে বাধ্য হলো। চলে গেলাম পীর ইয়েমেনি মার্কেটে। এক জন পীর মার্কেটের পিছনে শায়িত আছেন। শুরু হলো পাঞ্চাবী কেনা। কয়কটি দোকান ঘুরে একটি দোকানের সামনে কিছুক্ষন দাড়িয়ে ভিতরে ঢুকে একটি পাঞ্চাবী ছেলের পছন্দ হলো। নেড়েচেড়ে দেখার পর দাম জিজ্ঞাসা করা হলে দোকারদার বলেে,” মানুষের কাছে অনেকই চাই, আপনারা নিলে দিবেন ২২০০ টাকা। ছেলে আমার মুখের দিকে চায়। আমি বললাম ৩০০ টাকা। দোকানদার বললো,” আপনারা পাঞ্চাবী কিনতে আসেননি। উত্তরে বললাম এত দূর থেকে এসেছি দুই একটি পাঞ্চাবী না কিনে বাড়ি যাবো না। ছেলে কিছুটা অসন্তুষ্ট। এত কম দামে পাঞ্চাবী দিবে না। তাছাড়া এত কম দামে কিনবোই বা কেন? ছেলে কিছু বলতে চায়। কিন্তু আমি বলি শর্তের কথা। দোকান থেকে উঠি উঠি অবস্থা। দোকানদার অনুরোধ করে বলে, ” এত অল্প দামে পাবেন না কোথাও, একটি নেওয়ার দাম বলেন। কয়েকবার এমন বলে পীড়াপিড়ি করার পর বললাম ঠিক আছে- আপনি যেহেতু এতই বলছেন তখন আর ও ৫০ টাকা বাড়িয়ে দিবো, অর্থাৎ ৩৫০ টাকা। দেওয়া যাবেনা, নিতে পারবেনা না শুধু এসব কথা। বেরিয়ে যাচ্ছি অবস্থায় দোকানের অন্য একজন বলে, ঠিক আছে আপনি আর ৫০ টি টাকা দেন,৪০০ টাকা, ভালো এ পাঞ্চাবীটি নিয়ে যান। দেখলাম ছেলে অনেকটা বিরক্ত হয়ে গেছে তাই রাজী হয়ে গেলাম। ২২০০ টাকা চাওয়া পাঞ্চাবী ৪০০ টাকায় কিনলাম। পরে অন্য দোকান থেকে আর একটি পাঞ্চাবী ও অন্যান জামা কাপড় কিনে সেদিনের কেনাকাটা শেষ করলাম।
এমনি হলো আমাদের ব্যবসার অবস্থা। রমজান মাস, পবিত্র মাসে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামের কী অবস্থা হয় ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। অনেক নীতি কথা শুনি, অনেক ওয়াজ শুনি। এগুলো বলার পর মনে হয় সবকিছুর দাম আর ও বাড়ানোর প্রতিযোগিতা শুরু হয়। যা ইচ্ছে তাই দাম চাওয়া হয়। যদিও রোজাদারের পাশে দাঁড়ানোর তাগিদ রয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে একটি মেলা বা বাজারের কথা মনে পড়ে গেলো। পাঠকগণের নিকট ক্ষমা চেয়ে রাঙামাটির একটি মেলা উপলক্ষে যে বাজার বসে তার কথা বলছি। বৌদ্ধদের কঠিন চীবর দান উপলক্ষে ঐ বাজারটি বসে প্রতি বছর। রাঙামাটিতে কর্মরত থাকা অবস্থায় একদিন ঐ মেলা বা বাজারে গিয়েছিলাম। বাজারে যত দোকানে গিয়েছি প্রায় প্রতিটি দোকানদারই বলেছেন,” আপনার যা পছন্দ হয় নিন, বেশি দাম রাখবো না, আমরা এখানে ব্যবসা করতে আসিনি, পুণ্য অর্জন করতে এসেছি। সে বছর আমি সাশ্রয়ী মূল্যে ঐ মেলা থেকে অনেক কিছুই ক্রয় করেছিলাম যে কথা আজ ও স্মরণ হয়। জীবনে একবারই সহধর্মিনীর জন্য ৭ টি শাড়ি কিনেছিলাম ঐ মেলা থেকে যা স্মরণ করে এখনো রোমাঞ্চিত হই।
মুসলমানদের রোজা আসে, ঈদ আসে। রোজা ও ঈদে সাধারণ মানুষের কী ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা হয় আমরা সবাই জানি। মহান রাব্বুল আলামিন দয়া করে যদি আমাদের অর্থলোভী ব্যবসায়ীদের মনের অবস্থার পরিবর্তন করে দিতেন! এমন প্রত্যাশায় অল্প কথায় লেখাটি শেষ করলাম।
লেখকঃ সাবেক উপজেলা শিক্ষা অফিসার।