সামান্য প্রতিদান
নূরুদ্দীন দরজী
সে বছর রমজান ও ঈদ হয়েছিলো অগ্নি ঝরা মার্চ মাসে। বাংলাদেশের মানুষের জন্য মার্চ মাসটি একটি বহুল আলোচিত মাস। এ মাস বাঙালিদের জীবনে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। কিছু আনন্দ থাকলে ও এ মাসেই বাঙালিরা অশ্রু ঝরিয়েছে সব চেয়ে বেশি।
-রমজানের প্রায় শেষ পর্যায়ে। হাঁটে ঘাটে, শহর বন্দরের সর্বত্রই ঈদের বেচাকেনার ধুম পড়েছে। ক্রেতাদের ভিড়ে বাজার সরগরম। এরই মাঝে সুমনা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে- কেনাকাটা সেরে ফেলতে হবে। ঈদের দুই এক দিন আগেতো বাজারে ঢুকাই যায়না। সুমনা কলেজে পড়ুয়া মেয়ে। এবার স্থানীয় কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। পুরো নাম জমিলা আক্তার সুমনা। তিন ভাইবোনের মধ্যে সুমনা দ্বিতীয়। বড় ভাই রাজু সবেমাত্র পড়াশোনা শেষ করে চাকরির জন্য চেষ্টা করছে। ছোট ভাই চয়ন দশম শ্রেণিতে অধ্যায়নরত। তাদের বাবার বয়স আশির কাছাকাছি। তিনি বাড়ি থেকে তেমন বের হন না বলতে গেলে বয়সেরই কারণে। ঈদের কেনাকাটায় সুমনাকে সেদিন তিন ঘন্টা ব্যয় করতে হয়েছে। তবে পছন্দের সবকিছু পেয়েছে বলা যায়না। এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিলো বলে আর থাকা সমীচীন নয়। হঠাৎ একটি কসমেটিকস দোকান থেকে বের হচ্ছিলো বাড়ির উদ্দেশ্যে। দোকান থেকে নামার সময় একটি ছেলেের সাথে প্রচন্ড ধাক্কা লাগে। তার হাতের ব্যাগ মাটিতে পড়ে যায়। ছোট ভাই চয়ন সঙ্গে ছিলো। ছেলেটির প্রতি সুমনা রাগ হয়ে বলে,” চোখে দেখতে পান না? ভাই চয়ন ও উত্তেজিত হয়ে বলে উঠে,” কোথাও মেয়েদের দেখলেই বুঝি এমন করতে ইচ্ছে করে ? চয়ন বিষণ রাগান্বিত হয়ে দুর্ঘটনায় পতিত ছেলেকে ধরতে ও মারতে উদ্যত হয়। দোকানের আশেপাশে কয়েকজনের হস্তক্ষেপে তৎসময়ে বিষয়টি মারামারির রুপ নিতে পারেনি। কিন্তু সুমনা ও তার ভাই চয়নের রাগ কিছুতেই থামছেনা। তারা বিশেষ করে চয়ন শেষ না দেখে ছাড়বেনা বলে মারাত্মকভাবে হুমকি দিয়ে তখনকার মত স্থান ত্যাগ করে। ঘটনায় সংশ্লিষ্ঠ ছেলের নাম সফিকুল ইসলাম সুজন। সুমনাদের পাশের উপজেলায় গায়ের নাম হিজলতলী। বাবার নাম আলীম উদ্দিন। বাবা মৃত। সেদিন সুজন একটি বিশেষ পণ্য কিনতে এ জায়গায় এসেছিলো। আজকের দুর্ঘটনায় সে মানসিক ভাবে অপ্রস্তুত সবদিক দিয়ে। চিন্তিত মনে বাড়ি ফিরলে ও মানসিক যন্ত্রনায় কোনকিছুই তার ভালো লাগছিলো না।
এদিকে বিষয়টি মারাত্মক রুপ নেয়। সুমনার ভাইয়েরা একটি সুষ্ঠু বিচারের এজন্য নানাজনের সাথে কথা বলে। অনেকের পরামর্শে উপজেলার ক্ষমতাশীন দলের নেতা পর্যন্ত গড়িয়ে যায় । নেতার বক্তব্য হচ্ছে,” ঐ বাজারে এমন ঘটনার কথা প্রায়ই শুনতে হয়, এর একটি বিহিত করতে হবে,। নেতা আর ও বলেন “এমনটি আর বাড়তে দেওয়া যায়না,। সকলের প্রচেষ্টায় একটি তারিখ নির্ধারণ করে বিচার সভা বসার আয়োজন করা হয়। চতুর্দিকে বিষয়টি মোটামুটি ছড়িয়ে জানাজানি হয়ে যায়। সুজনকে উপস্থিত থেকে তার কথা বলার জন্য ও খবর পাঠানো হয়।
সে তারিখে সবাই উপস্থিত হয়ে বিচার কার্যক্রম শুরু করে । আত্ম পক্ষ সমর্থনে সুজনকে তার পরিচয় দিয়ে বক্তব্য রাখতে বলা হয়। সুজন নিজের গ্ৰামের ও বাবার নাম বলে শান্তভাবে বলতে লাগে। প্রথমেই বলে,” ঐ দিনের ঘটনা নিছকই দুর্ঘটনা, হঠাৎ করে নামতে গিয়ে মার্কেটের সিঁড়ির নিচে কার সাথে ধাক্কা লেগেছে আমি আজ ও ভালোভাবে জানি না, আমি ইচ্ছাকৃত কোনকিছুই করিনি। উপস্থিত অনেকেই বিভিন্ন শ্লেষাত্মক কথাবার্তা বলতে লাগলে পরিস্থিতি উত্তেজিত হয়ে পড়ে এবং এক সময় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার উপক্রম হয়। নানাজনে নানা উক্তি করতে থাকে। অনেক কষ্ট করে সভায় উপস্থিত হয়েছিলেন সুমনার বাবা আমজাদ হোসেন। তিনি আলীম উদ্দিন নামটি শুনেই কি জানা এক অজানা স্মৃতি তাড়িত হয়ে পড়েন। বার বার চিন্তা করতে থাকেন কে ঐ আলীম উদ্দিন? সুজনের কাছে তার বাবা সম্পর্কে বার বার জানতে চান। সুজনের মুখ থেকে সবকিছু শুনে তিনি আলীম উদ্দিনকে চিনতে পেরে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন। সবার উদ্দেশ্য তিনি বলে উঠেন, “আর বিচারের দরকার নাই, বিচার হয়ে গেছে,। আপনারা চলে যান-বাকিটা আমি দেখবো,। তিনি সুজনকে কাছে ডেকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলেন,”ওরে সুজন ,তোর বাবা আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলো, আমরা একই স্কুলে পড়াশোনা করেছি- স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এক সাথে প্রশিক্ষন নিয়ে একই গ্ৰুপে যুদ্ধ করেছি।” হানাদার বাহিনীকে একটি জায়গায় আক্রমণ করে আমি মহা বিপদে পড়ে গিয়েছিলাম,। “আমি এক জায়গায় আটকে বিপদে পড়ে গেলে আলীম উদ্দিন আমাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসে- আর তখন এক পাপিষ্ট পাকিস্তানি তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়লে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে,। সেদিন আলীম উদ্দিন না থাকলে আজ আমি বেঁচে থাকতে পারতাম না, তাঁকে আমরা কোন রকমে উদ্ধার করতে পারলে ও তাঁর দুটি পা নষ্ট হয়ে যায়,। “আলীম উদ্দিন আজ নেই বটে,কিছু আমি এখনো বেঁচে আছি, আলীম উদ্দিন যুদ্ধ করেছিলো বলেই আজ এ দেশ স্বাধীন,। আমজাদ সাহেবের কথা শুনে উপস্থিত সকলে শিহরিত হয়ে উঠেন। সবাই অশ্রুসজল। আমজাদ হোসেন সুজনকে বলেন,” চলো বাবা, আমাদের বাড়িতে,! সুজনের চোখে ও তার বাবার কথা শুনে পানি এসে যায়। সভা ভঙ্গ হলে সুজন সেদিন কোথাও না গিয়ে সোজা নিজেদের বাড়ি চলে যায়।
একজন মেয়ে মানুষ বলেই বোধ হয় সুমনা সেদিন দরবারে উপস্থিত হয়নি। বাবা, ভাইরা বাড়ি এলে উচিত বিচারের প্রত্যাশায় থাকা সুমনা আগ্ৰহ নিয়ে সবকিছু জানতে চায়। বাবার মুখে সব শুনে সে আশ্চর্য, অভিভূত এবং শিহরিত হয়ে পড়ে। সহসাই আত্মগ্লানিতে নিজের সেদিনের কৃতকর্মের জন্য অপমান বোধ করে এবং দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। পরের দিন সুমনা তার বাবা ও ভাইদের নিয়ে সুজনদের বাড়ি চলে আসে। আত্মীয়তার নিভীর বন্দনে তারা আবদ্ধ মনে হয়। এক অনাবিল প্রশান্তিতে সবাই উদ্ভাসিত হয়। কী করবে প্রতিদান ভেবে ভেবে আবেগে তন্ময় হয়ে পড়ে। একাত্তরের রণাঙ্গনে আলীম উদ্দিনের মত মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন বলেই আজ আমাদের সবুজ বাংলাদেশ।
লেখকঃ সাবেক উপজেলা শিক্ষা অফিসার।