হরিষে বিষাদ
মোঃ হাবিবুর রহমান
বহুদিন অতীত হতে চলছে। যে ঘটনাটির দৃশ্যপট সাময়িক ভুলে গেলেও কোন বিয়ের আসরের সমবেত লোকালয় দৃষ্টিগোচর হলেই মনে পড়ে যায় ওই দিনের করুন চিত্রটি। প্রত্যক্ষ উপলব্ধি বাস্তবতার সংক্ষিপ্ত সারমর্ম যার প্রেক্ষাপট হৃদয়ে এক সুপ্ত ব্যথার গভীর অনুভূতি জাগে, ইচ্ছে হয় যদি কোন যান্ত্রিক বা আধ্যাত্বিক বিকিরণের সুযোগ থাকতো তবে এ সমবেদনা হৃদয়বান সহানুভূতিশীল সহমর্মিতা বোধগম্য স্বজনের হৃদয়ে পৌঁছে দিতে পারলে আমার অনন্ত লব্ধ ব্যথা আংশিক উপশম যে হতো তাতে কোন সন্দেহ নেই। পল্লীর এক পিতৃহারা কৃষকের কন্যা লীলাবতী। জন্মের দু’বছর পর পিতা মারা যায়। মায়ের স্নেহের লালিত হয়ে আজ লীলাবতী ১৭/১৮ বছরে পা দিয়েছে।সংসার চলার দৈন্যতায় শত সমস্যায় জর্জরিত হয়েও শিক্ষা ক্ষেত্রে এবার দশম শ্রেণিতে উন্নীত হয়েছে। পাড়ার লোকেরা লীলাবতীর মাকে নানা কথা বলে। বিয়ের উপযুক্ত হয়েছে তাই মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেয়াই ভাল।গরিবের মেয়েরা লেখাপড়া শিখলে রান্নাবান্না কাজ করেই জীবন কাটাতে হয়। লীলাবতীর মা সহজ সরল মনের মানুষ। তাই লোকজনের নানা কথায় তার সরল মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। আপনজনকে বলতে থাকে লীলাবতীর পাত্র খুঁজিবার জন্য। উপযুক্ত পাএে মেয়েকে পাত্রস্থ করার চিন্তায় সর্বক্ষণ প্রহর শুনতে থাকে লীলাবতীর মা। সহসা এক পাত্রের সন্ধান পাওয়া গেল জনৈক পেশাদার বিবাহ বন্ধনকারী উকিলের মাধ্যমে।পাত্র গত বছর মেট্রিক ফেল করেছে, কৃষি কাজ করে। দেখায় বেশ ভালো, লীলাবতীর সাথে মানাবে। উকিলের আমন্ত্রণে ছেলে পক্ষের সকল আত্মীয়-স্বজন গুনগ্রাহী নিয়ে দফায় দফায় লীলা কে দেখে পছন্দ হয়েছে। উভয় পক্ষই রাজী ও খুশী ।
আজ কনের বাড়িতে দু’পক্ষ বসে দিনক্ষণ ধার্য করবে। বরপক্ষের ১৫/১৬ জন আগত মেহমান ভুড়ি ভোজনান্তে দিন পঞ্জিকা দেখে আলাপ আলোচনায় আগত ৭ম দিনে শুভ বিবাহের তারিখ ধার্য করা হয়েছে। কিন্তু বিধি বাম। যৌতুকের টাকার অংকটি তারিখের পূর্বে বরের বাড়িতে পৌঁছে দেয়াই বিয়ে বন্ধনে বাধ সেজেছে। এ বাধ রোধের আলোচনার চরম অবস্থার ক্রান্তি লগ্নে মেয়ে পক্ষের এক বৃদ্ধ বরপক্ষের যৌতুক পিয়াসী মেহমানদের সাথে আগত অভিভাবক ভাবি বরের ভগ্নিপতি কোন এক মসজিদের ইমাম, এ মৌলভী সাহেবের নিকট মিনতি আবদার জানালো এই বলে যে, বিয়ের দিনই দাবীকৃত সমুদয় টাকা পরিশোধ করে দেয়া যাবে, বৃদ্ধ লোকটি আরও বললেন যে, একখন্ড জমির উপর বন্ধকি টাকা সংগ্রহ করতে হবে। এতে সময় লেগে যাবে এ’কদিন। তাই দয়া করে ওই সময়টুকু আমাদিগকে দিন। এহেন প্রস্তাবের পর উপস্থিত সকলেই কিছুক্ষণ নীরব রইল।প্রত্যেকেরই দৃষ্টিপাত ইমাম সাহেবের প্রতি। যিনি দ্বীনি শিক্ষায় শিক্ষিত। বসন ভূষনে ইসলামী বিধানে নির্দেশিত রূপরেখার কোথাও কোন কমতি নেই, তার কন্ঠ থেকে গঠন মূলক তৃপ্ত বাণী লাভের আশায় আশান্বিত আসনে উপস্থিত সুধী জন, পর্দার আড়ালে কনের মা, বোন ও পাড়াপড়শী মমতাময়ী হিতাকাঙ্খী নারীবৃন্দ অধির আগ্রহে অপেক্ষমান। এ দৃশ্য অবলোকন মনে হচ্ছে কোর্টে যেন মহামান্য বিচারকের রায়ের দৃষ্টির বাদী বিবাদীর হৃদয় স্পন্দনের এক নীরব ব্যাকুলতা, যাওয়ার সময় সংকীর্ণ হলেও অপেক্ষা পীড়নের জটিলতা তাদের ঘড়ির টিকটিকি ধ্বনিধারী চলন্ত কাটার গতি যেন অতীব মন্থর। তবে সকলেই আশাবাদী এই মর্মে যে, ধর্ম প্রাণ গুণান্বিত ব্যক্তিটি সমাজের কুসংস্কার ও বিজাতীয় কুপ্রথার অনুকূলে অভিশপ্ত যৌতুক প্রথা,আলোক সজ্জিত তোরণ,কনে পক্ষের অপারগতা সত্বেও বরযাএী নামক রাক্ষুসে বাহিনীর ভুড়ি ভোজ সভা ইত্যাদি সকল সমস্যা থেকে পরিত্রানের উপায় এ ইমাম সাহেবের কন্ঠের বাণীতে সুষ্ঠু সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য,ধর্মান্ধ ওই নামদারি মৌলভী মসজিদের ইমাম আল্লাহর হুকুম রাসুলের তরীকাকে তুচ্ছ করে শুভ বিয়েকে অশুভে রূপান্তরিত করার নিকৃষ্ট প্রয়াস থেকে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে মুখে পান চিবুতে চিবুতে কুহাস্য বদনে প্রস্তুতি নিলেন কিছু বলার জন্য।মনে হলো ক্যালকুলেটরে খরচের হিসেবের ফিরিস্তি তৈরি করে যেন বক্তৃতা মঞ্চে উপস্থিত হয়েছেন। অতঃপর বিভিন্ন মুছাবিদা উপস্থাপন করতঃ দীপ্ত৷ কণ্ঠে তিনি বললেন আগত ৭ম দিনেই বিয়ের দিন তারিখ ঠিক থাকবে।
তবে দাবীকৃত টাকা আগামীকাল অবশ্যই পৌঁছে দিতে হবে। তিনি আরো বোঝাতে চেষ্টা করলেন যে, বর সাহেব একজন সু-বন্ধু-বান্ধব বেষ্টিত আনন্দময়ী যুবরাজ তুল্য। তাই বিয়ের দিন সু-শোভিত তোরন সাজাতে হবে এবং শতাধিক বরযাত্রী না হলে শরমের কোন অন্ত থাকবে না। তিনির দাবিগুলো পূরণ হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে বক্তব্যের যবনিকা টানলেন।স্বচ্ছ আকাশে বিনা মেঘে বজ্রপাত ঠিক তেমনি যেন কনে পক্ষের আশাবাদীদের মন বজ্রের আঘাতে নিমিষেই ধরাশায়ী হয়ে গেল। অবশেষে শুভ বিবাহের কলঙ্কিত অধ্যায় রচনাকারী, মৌলভী সাহেব বরপক্ষদ্বয়কে সাথে নিয়ে কনের বাড়ি থেকে ধীরে ধীরে বিদায় হতে চললেন। এদিকে দূর গৃহকোণ থেকে ভেসে আসলো কণের মার দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয় নিংড়ানো চাপা কন্ঠের মর্মস্পর্শী ক্রন্দন ধ্বনি ও অপর এক স্বজনের সান্তনা বাণী,”দুঃখ করোনা বোন সবই আল্লাহর লীলা।লীলাবতীর বিয়ের জুরিতে যদি এ ছেলের নাম লিখা থাকে তবে পুনরায় তারা ফিরে আসবে। “ততক্ষণে বিদায়ী যাত্রীরা চলে গেছে অনেক দূরে। লীলাবতীর মা সবেমাত্র কান্না থামিয়ে মনের আশার বাঁধন বেধে ঘরের জানালার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে থাকে বিদায়ী যাত্রীদের পথে।
লেখক: সাংবাদিক ও সহ সভাপতি শিবপুর প্রেসক্লাব.