নূরুল ইসলাম নূরচান ৯০ দশকের গোড়ার দিকে লেখালেখি শুরু করেছিলেন। দীর্ঘদিন যাবত লেখালেখির কারণে তার নিজস্ব একটি পাঠক বলয় তৈরি হয়েছে। তিনি পেশায় একজন সাংবাদিক। তাঁর এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা পাঁচটি। লিখেন গল্প, উপন্যাস, কবিতা। ইতিমধ্যে তিনি ‘বাস্তববাদী কবি সাহিত্যিক’ হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছেন।
তার নির্মাণেও খুঁজে পাওয়া যায় কবিতার বাস্তব শরীর। কেননা কবিতার সঙ্গেই তার সব ধরনের বসবাস।
কবিতায় যেন কৃষক, শ্রমিক, মজদুর, শোষিত বঞ্চিতের জবান ফুটে ওঠে।
মূল আলোচনার আগে জেনে রাখা ভালো, নূরুল ইসলাম নূরচান একাধারে প্রবীণ সাংবাদিক, ঔপন্যাসিক, গল্পকার ও কবি।
এ পর্যন্ত তার পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে ১. ‘এরই নাম জীবন’ (১৯৯৭), ‘বাইশে মাঘ’ (২০১০), ‘চেনা পৃথিবী অচেনা মানুষ’ (২০১১), ‘অবশেষে’ এবং ‘হঠাৎ একদিন’ (২০২৪)।
‘অবশেষে’ কবিতার বইটি প্রকাশ করেছে প্রতিবিম্ব প্রকাশ। প্রচ্ছদ করেছেন এ কে লাডু।
বইটিতে ৫৬টি কবিতা স্থান পেয়েছে। এই বইয়ের কিছু কবিতা সম্পর্কে কিছু বলার চেষ্টা করবো। তার আগে জেনে নিই তার কবিতা সম্পর্কে সমালোচকরা কী বলেন, ‘মাটি থেকে, নদীর জলের থেকে, বিলের কাদা থেকে, গোবর ও খড়ের গাদা থেকে উঠে আসে নূরুল ইসলাম নূরচানের কবিতা।উদ্ভট আর উৎকট গন্ধ নিয়ে মার্জিত ও দুরস্ত নাগরিক রুচির ওপর কখনো জবরদস্তি, আবার কখনো জবর-দোস্তির মতো সেই কবিতা। কখনো তা বুনো স্বাদের, কখনো তা বিষাদের।
আবার অনেকেই মনে করেন, ‘তার এই আকাড়া চালের মতো কবিতা কারো জন্য স্বস্তির, কারো জন্য অস্বস্তির, আর কারো জন্য প্রশস্তির।
কবির উপলব্ধি গভীরভাবে ভাবায় পাঠককে। তার চিন্তা-চেতনা ভিন্ন মাত্রা এনে দেয়।
‘আমার ঘর’ কবিতায় কবি বলেন—
‘কালবৈশাখী তুমি এসো না আমার ঘরে/তোমার ভয়ে আমার অন্তর কাঁপে ডরে/ ঘরের সবগুলি খুঁটি নড়বড়ে/ আমার ঘরখানি যদি পড়ে/ তাহলে থাকতে হবে আমায় অন্যের ঘরে/-‘
‘আল বেয়ে হাঁটে’ কবিতায় কবি বলেন–
‘আজকাল স্বপ্নরা অপরূপ খেলায় মেতে ওঠে/ কৃষক তার শস্য দেখে মাঠে, ঝলমলিয়ে ওঠে/ সোনালি ধান/ জরিনা তাঁতে বোনা রঙিন শাড়ি পরে/ সবুজ ঘাসের গালিচা মাড়িয়ে আল বেয়ে হাঁটে/-‘
‘কামার কুমার জেলে’ কবিতায় কবি বলেন-
‘তোমরা আমার ভাই/ তোমরাই আমার প্রাণ/ তোমাদের গুণ নিয়েই/ গাইছি জয়গান/ কৃষক ফলান শস্য/ বাঁচায় মোদের প্রাণ/-‘
‘সারা শরীরে ক্ষত’ কবিতা-
‘আমার সারা শরীরে ক্ষত/ এক জায়গায় দগদগে ঘা/ কেন এমন হয়েছে, কী চেয়েছিলাম আমি?/ এক মুঠো অন্ন,শুধুই অন্ন,আমি কর্ম অক্ষম/ ক্ষত আর ঘা বুয়ে বেড়ানো যায়/ কিন্তু ক্ষুধার জ্বালা কী গায়ে সয়!/ অন্ন চাইতে গিয়ে এজন সেজনের আঘাতে/ আমার সারা শরীর হয়ে গিয়েছে বিধ্বস্ত/ করুণা চাই না, আমি চাই অন্ন।/-‘
‘কলমের ব্যর্থ কান্না’ কবিতায় কবি বলেন-
‘কলমের কান্না কেউ শুনে না/ অথচ সে প্রতিনিয়তই কাঁদে/ তার কান্নার কারণ, সত্য বলতে না পারা, সত্যরা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে/ কলম কাঁদে তাকে অনেক ‘মানুষ’ অপব্যবহার করছে, যা হবার কথা ছিল না তাও তাকে দিয়ে করানো হচ্ছে/ আজকাল কলমও কাঁদে ব্যর্থ কান্না/-‘
‘অধিকার’ কবিতায় কবি বলেন-
‘ওরে শোষিত বঞ্চিতের দল/ তোরা জেগে ওঠ, চিৎকার করে বল- ফিরিয়ে দে আমাদের ন্যায্য অধিকার/ আমরা চাই না করুণা/-‘
‘মুখোশ’ কবিতায় কবি বলেন-
‘শকুনের দল উড়ছে চারদিকে/ তাই ভ্রমররা ছুটছে দিগ্বিদিক/ প্রবল হিমে জবুথবু ফুল/ মধু নেই সেখানে/ মুখোশ পরা মানুষ/ আজ শকুন সেজে/ কেড়ে নেয় মানুষের অন্ন, বস্ত্র বসতি/-‘
‘শান্তি সুখের বাস চাই’ কবিতায় কবি বলেন-
‘মানুষ যখন যায় নিদ/ চোর ডাকাত কাটে সিঁধ/ সফল হলে তারা হাসে/ গেরস্ত চোখের জলে ভাসে/-‘
‘আমার দেশ’ কবিতাটির অংশবিশেষ-
‘দেশ থেকে দেশান্তরে/ হয় যেখানে চলার শেষ/ এইতো আমার জন্মভূমি/ আমার বাংলাদেশ/-‘
‘বীর সন্তান’ কবিতার ক’টি লাইন এরকম-
‘এইতো আমার জন্মভূমি/ এইতো আমার দেশ/ লাল- সবুজের পতাকাটা/ দেখতে লাগে বেশ/ দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করে/ মুক্তিসেনা বীর/ এনে দিলে মাতৃভূমি/ লাল-সবুজের নীড়/-‘
সবশেষে বলা যায়, ‘অবশেষে’ বইয়ের প্রায় সবগুলো কবিতাই পাঠককে বিমোহিত করবে। আপ্লুত করবে। ভাবতে বাধ্য করবে। কবি নূরুল ইসলাম নূরচানের এই ধারা অব্যাহত থাকবে, এমন আশা-প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি। কবিতার এ বাঁক বদলের খেলা আমাদের উদ্বুদ্ধ করবে। কবিতা পাঠে আগ্রহী করবে।তাঁর বইয়ের বহুল প্রচার কামনা করছি।