আবদুল মান্নান ভূঁইয়া ও একটি অসমাপ্ত সংগ্রাম
আকবর আলী খান
মান্নান ভূঁইয়ার সাথে আমার পরিচয় ১৯৬১ সালে – আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে। একই হলে থাকি, বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিভাগে ও একই শ্রেনীতে পড়ি। একই সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ছাত্র ইউনিয়নের নিশানের আয়ুব বিরোধী আন্দোলন করি। তাই পরিচিত থেকে বন্ধু, বন্ধু থেকে অতি অন্তরঙ্গ আপন জন হতে খুব একটা সময় লাগেনি। সেই ১৯৬১ সাল থেকে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত প্রায় পাঁচ দশক তাঁর সাথে আমার নিবিড় বন্ধন অটুট ছিল। তবে আমি সরকারী চাকুরী করাতে ও প্রায় চৌদ্দ বছর দেশের বাইরে থাকায় যোগাযোগ সব সময়ে নিয়মিত ছিল না। কিন্তু বন্ধন অচ্ছেদ্য। দূরে থাকলেও একে অপরের খোঁজ খবর ঠিকই রাখতাম।
মানুষ হিসেবে মান্নান ছিল অসাধারণ। বিপদে আপদে সব সময়ে তিনি বন্ধুদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বন্ধু-বাৎসল্যের জন্য অনেক সময় তাঁকে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে। তবে তিনি এ ব্যপারে কোন দিন পিছু হটেন নি।
তাঁর সৌজন্য-বোধে কখনো কোন খঅদ দেখা যায়নি। অন্তত আমি তাঁর সৌজন্যের সাথে কখনো পাল্লা দিতে পারিনি। মান্নান যখন ১৯৯১ সালে প্রথম মন্ত্রী হন, তখন আমিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ দূতাবাসে ‘ইকনমিক মিনিস্টার’। কুটনীতির ভাষায় ‘মিনিস্টার’ হলেও আসলে ছিলাম সরকারের একজন যুগ্ম-সচিব। তাঁর মন্ত্রিত্ব গ্রহণের কয়েক মাস পরে সরকারি কাজে আমি ঢাকায় আসি। আমি ঢাকায় আসার আগে আমার অবস্থানের সময় জানিয়ে তাঁর একান্ত সচিবকে আমার সাথে মন্ত্রীর একটি সাক্ষাতের সময় ঠিক করতে অনুরোধ করি। আমি ভেবেছিলাম যে, যে দিন আমি ঢাকায় পৌঁছব সে দিন বিমান ভ্রমণের ক্লান্তি কাটিয়ে পর দিন মন্ত্রীর অফিসে সুবিধাজনক সময়ের জন্য যোগযোগ করব। আমি দুপুরে ঢাকায় বিকাল অবধি ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠাৎ বাসার লোকজন ঘুম ভাঙ্গিয়ে জানায় যে, খোদ মন্ত্রী মহোদয় হাজির হয়েছেন।
পরে শুনেছি তিনি নাকি বলেছেন যে আমাকে কোন এপয়েনমেন্ট দেওয়া যাবে না, তাই তিনি নিজেই সশরীরে হাজির হবেন। তবে তিনি যখন সরকারের মন্ত্রী ছিলেন ও আমি সচিব ছিলাম তখন কখনো কখনো বাধ্য হয়ে এপয়ন্টমেন্ট নিতে হয়েছে। এ রকম একটি ঘটনা মনে পড়ছে। আমি তখন মন্ত্রীপরিষদ সচিব। সরকার মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে মরনোত্তর স্বাধীনতা পুরষ্কার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। অনুষ্ঠানের দুই দিন আগে আমাকে জানানো হয় যে মওলানার ওয়ারিশানদের মধ্যে কে পুরষ্কার নেবেন সে সম্পর্কে বিরোধ দেখা দিয়েছে। আমার জানামতে মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে মান্নান ভূঁইয়াই মওলানার পরিবারের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ছিলেন। আমি তাই সমস্যাটির জন্য মান্নান ভূঁইয়ার হস্তক্ষেপের ব্যবস্থা করার জন্য তাঁর সাথে তৎক্ষনিক সাক্ষাতের ব্যবস্থা করতে তাঁর একান্ত সচিবকে অনুরোধ করি। মন্ত্রী তখন বাসায়। একান্ত সচিব আমাকে তাঁর বাসায় যেতে পরামর্শ দেন। বাসায় গিয়ে দেখি নীচের তলায় সবগুলি কক্ষ লোকে গিজগিজ করছে। মন্ত্রীকে কোথায় দেখা যাচ্ছে না। একটি সোফায় ২/৩ মিনিট বসার পর হন্তদন্ত হয়ে একান্ত সচিব এলেন। আমি প্রশ্ন করলাম, “মন্ত্রী কোথায়”? । একান্ত সচিব বললেন, তিনি এখানেই আছেন। চলুন আপনাকে নিয়ে যাই। আমি অবাক হয়ে তার পিছু গেলাম। একান্ত সচিব একটি তালাবদ্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে চাবি বের করে দরজাটা খুললেন। এবার ভেতরে মান্নান ভূঁইয়াকে কিছু লোকের সাথে আলোচনারত অবস্থায় দেখা গেল। ভেতরে গেলে মান্নান ভূঁইয়া লোকজন বিদায় করে জানালেন যে সব সাক্ষাতকারী সবার আগে কথা বলতে চায়। ঠেলাঠেলিতে কারো কথাই শোনা যায়না। তাই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কথা শোনার জন্য এই তালাবদ্ধ কক্ষের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তিনি নিজের বাড়ীতে বন্দী অবস্থায় থাকেন, তবু তিনি অনভিপ্রেত সাক্ষাতকারীদের জন্য তাঁর দ্বার বন্ধ করে দিতে রাজি নন। যতক্ষন পর্যন্ত সম্ভব তিনি তাঁর ভোটার ও দলের কর্মিদের কথা শুনতে চান। এই ছিলেন মান্নান ভূঁইয়া।
পদের গরিমা কখনো তাঁকে গর্বিত করেনি। শত সহস্র দলীয় ও সরকারী দায়িত্ব পালন করলেও তিনি কখনো জনসাধারন হতে বিচ্ছিন্ন হননি। তিনি ছিলেন রাজনৈতিক সহিষ্ণুতার মূর্ত প্রতীক। তাঁর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দীদের কাছে শুনেছি, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফল ঘোষিত হলে এবং তিনি জয় লাভ করলে প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রার্থীদের বাড়ী গিয়ে দেখা করতেন ও প্রতিদ্বন্দ্বীদের সহযোগিতা নিয়ে কাজ করা ওয়াদা করতেন। তিনি ওই ওয়াদা পালনও করতেন। দেশের রাজনৈতিক নেতারা তাঁর আদর্শ অনুসরন করলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক কৃষ্টিতে বড় ধরনের পরিবর্তন সম্ভব হতো। বাংলাদেশের সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিবেশে ব্যক্তি আবদুল মান্নান ভূঁইয়া সুস্থ রাজনীতির একজন আদর্শ বা রোল মডেল হিসাবে গণ্য হওয়ার যোগ্য।
ছাত্র জীবন থেকে আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার দুটি স্বপ্ন ছিল। একটি হল বাংলাদেশের স্বাধীনতা আরেকটি হল এদেশের মেহনতী মানুষের মুক্তি।
তাঁর স্বপ্ন সফল হয়েছে। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। বামপন্থি নেতা হিসাবে ভারত সমর্থিত মূল স্রোতধারায় তাঁর সক্রিয় অংশ গ্রহণ সম্ভব ছিলনা। তাই তিনি দেশের ভিতরেই তাঁর জন্মভূমি শিবপুর অঞ্চলে সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলেন। দেশের বাম নেতৃবৃন্দ মান্নান ভূঁইয়ার সেনাপতিত্বে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। এই প্রতিরোধ মূল ধারার পরিপুরক হিসাবে কাজ করে। ১৯৭১ এর মুক্তি সংগ্রাম বাইরের কোন সমর্থন ছাড়া বাংলাদেশের ভিতর থেকে এ ধরনের প্রতিরোধ অতি অল্পেই গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছিল। তাঁদের এই সীমিত অথচ ব্যতিক্রমধর্মী অবদান আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি উজ্ঝল অধ্যায় হিসাবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
এদেশের মানুষের মুক্তির যে স্বপ্ন মান্নান ভূঁইয়া দেখিয়েছিলেন তা অবশ্য বহুলাংশে সফল হয়নি। এই লক্ষ অর্জনের জন্য তিনি কখনো শ্রমিক আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন, কখনো কৃষক সংগঠন গড়ে তুলেছেন। কিন্তু তৃণমূলে অসন্তোষের স্ফুলিঙ্গকে সারা দেশে দাবানলে রূপান্তরিত করতে পারেন নি। তাই সব শেষে তিনি নিয়মতান্ত্রীক রাজনীতিতে যোগ দেন। এখানে তিনি দ্রুত ব্যক্তিগত সাফল্য অর্জন করেন। তিনি ও তাঁর বামপন্থী সহযোগিরা বিএনপিতে একটি শক্তিশালী ধারা হিসাবে আত্ম-প্রকাশ করে। তারা দুই মেয়াদে দশ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। যদিও মান্নান ভূঁইয়াদের পক্ষে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়নি, তবু তারা রাজনীতিতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। প্রথমত, তাদের রাজনৈতিক কর্মকান্ডের ফলেই বিএনপি একটি পুরোপুরি ডানপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল দলে পরিনত হতে পারেনি। দ্বিতীয়ত দাতাদের চাপ সত্ত্বেও সরকার শ্রমিক কৃষকদের স্বার্থ-বিরোধী ব্যবস্থা নিতে অনেক ক্ষেত্রে বিরত রয়েছে।
তবে বাংলাদেশে নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় দূর্বলতা হলো পরিবার-তান্ত্রিক কাঠামোতে অনুদার গণতন্ত্র। জীবনের গোধূলী লগ্নে তিনি গণতন্ত্রায়নের তাগিদ অনুভব করেন। কিন্তু এ সম্পর্কে অর্থবহ উদ্যোগ গ্রহণের আগেই ঘাতক ব্যাধি তাঁর দেহে বাসা বাঁধে। তাই তাঁর জীবনের সবচেয়ে অর্থবহ সংগ্রামের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। তবে পুরো-দমে শুরু করতে পারেন নি। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হলে দেশের শাসন ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া কেন্দ্রীভূত শাসন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। মূল্যবোধের ভিত্তিতে রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন করতে হবে। গণতন্ত্রের গণতন্ত্রায়নের জন্য অসমাপ্ত সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে হবে।
লেখক : সাবেক সচিব ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার