• বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫, ১১:১৯ অপরাহ্ন

খোলা কলাম:: আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন বিরল মানুষের একজন তিনি :: প্রফেসার এসএস মো: নূর নবী

admin / ৩১ Time View
Update : রবিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪

নূর নবী 

আমি তখন নরসিংদীর সরকারি শহীদ আসাদ কলেজে কর্মরত । কলেজ সংলগ্ন বাসা। সপরিবারে বসবাস । একদিন হালকা শীতের বিকেলে শিক্ষক মেসের সামনে খোলা মাঠে চার পাঁচজন সহকর্মী বসে গল্প করছিলাম। হঠাৎ স্হানীয় কয়েকজন মিলে একজন বিদেশিকে আমাদের নিকট নিয়ে আসলো। আমরা ভদ্রলোকের পরিচয় জানতে চাইলাম।

ভদ্রলোক বললেন, ওনি ব্রিটেনের নাগরিক। ওনার বাবা সিলেটের আর মা লন্ডনের। বাংলাদেশে এসেছেন বেড়াতে। ভদ্রলোক একাই বের হলেন। ওনার কোনো সাথী ছিল না। গন্তব্যবিহীন ভ্রমণ। সিলেট থেকে ঢাকা । ঢাকা থেকে বগুড়া। ওখানে ঘুরতে ঘুরতে এক সময় ওনার সাথে থাকা অর্থ ও পোশাকসহ সবই ছিনতাই হয়ে গেল। গায়ে থাকা পোশাক আর একখানা বাংলাদেশি এক দেড় শ’ টাকা দামের চাদর ছাড়া সম্বল বলতে কিছুই ছিল না । কপর্দকশূন্য ভদ্রলোকের সাথে খাবার সংস্হান ছিল না। কারো নিকট হাত পাতা বা দয়া ভিক্ষা করার কথা ভাবতে পারেন নি। তখন তো মোবাইলেরও তেমন ব্যবহার বাংলাদেশে শুরু হয় নি।
ভদ্রলোক বগুড়া থেকে হাঁটা শুরু করলেন । অভুক্ত মানুষটি পৌঁছলেন ঢাকা। ঢাকা থেকে নরসিংদীর শাহে প্রতাপ হয়ে ইটাখোলার পরিবর্তে ভুল করে শিবপুর বাসস্ট্যান্ড। সিলেট যাওয়ার পথ ছিল ইটাখোলা থেকে ডানে । ভুলে ওনি সোজা চলে এসেছেন।
ভদ্রলোক বললেন আমাদের নিকট পৌঁছাতে ওনার সময় লেগেছে তিন দিন এবং বিস্ময়ের ব্যাপার হলো এ তিন দিন তিনি কিছুই খান নি রাস্তার পাশের টিউবওয়েলের পানি ব্যতীত।
শুনে হতবাক হলাম, ব্যথিতও হলাম। এতো খারাপ লাগছিল ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না । আমাদের দুপুরের খাওয়া হয়ে গেছে অনেক আগেই । ভদ্রলোক এসেছেন বিকেল চারটার দিকে। মেসে কোনো খাবার নেই । বাসায় গেলাম। ভাবলাম বাসায় খাবার না থাকলে হোটেলে ব্যবস্থা করবো। আল্লাহ্ মেহেরবান । রিযিকের মালিক আল্লাহ্ । বাসায় এক প্লেট পরিমাণ ভাত ছিল আমাদের খাবার পর। এসে ভদ্রলোককে নিয়ে গেলাম। যেতে চান নি। দেখলাম ওনি খুবই ক্ষুধার্ত এবং ক্লান্ত । সবাই মিলে এক প্রকার জোর করেই তাকে বাসায় নিয়ে গেলাম। ওনার জন্য এতোই খারাপ লাগছিল যে, ওনি যে চামচ ছাড়া হাত দিয়ে খেতে অভ্যস্ত না ভুলে গিয়েছিলাম । ওনি কিছু বলেনওনি। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম ওনার হাত দিয়ে খেতে কষ্ট হচ্ছে । চামচ দিলাম। ওনি এতোই ক্লান্ত ছিলেন যে , হাত কাঁপছিল । অনেক কষ্টে খাওয়া শেষ করলেন।
আবার চলে আসলাম শিক্ষক মেসের সামনে । ওনাকে বললাম এখান থেকে সিলেট অনেক দূর । হেটে যাওয়া খুবই ঝুঁকিপূর্ণ । আমরা তাকে ভাড়া দিয়ে সিলেটের গাড়িতে উঠিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। ওনি কিছুতেই আমাদের প্রস্তাবে রাজি হলেন না। ওনি বললেন, আমার গায়ের চাদরটা বিক্রির ব্যবস্থা করিয়ে দিন। ওই টাকায় যতটুকু সম্ভব যাব, বাকি পথ হেঁটে যেতে পারবো। ওনাকে আমাদের নিকট নিয়ে আসা শিবপুরের স্হানীয় ভদ্রলোকদের একজন ওনার উপকারার্থে প্রয়োজন না থাকলেও দেড় শ’ টাকা দিয়ে চাদরখানা কিনে রাখলেন। আমি আমার এক সহকর্মীসহ ওনাকে ইটাখোলা নিয়ে যাই এবং সিলেটগামী বাসে উঠিয়ে দেই।
মানুষ কতোটা আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন হতে পারে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেলেন ভদ্রলোক।

লেখক ::
প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
শিবপুর সরকারি শহীদ আসাদ কলেজ , নরসিংদী ।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category