• বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫, ০৫:৩৫ পূর্বাহ্ন

গণমানুষের প্রিয়নেতা আবদুল মান্নান ভূঁইয়া ::: প্রফেসর ড. জসীম উদ্দিন আহমদ

admin / ১৫১ Time View
Update : রবিবার, ২৪ মার্চ, ২০২৪

২৮ জুলাই এ দেশের গণমানুষের জীবনে এক শোক বিহ্বল দিন। ২০১০ সনের এই দিনে বাংলাদেশের রাজনীতির এক “তারকা পুরুষ” সুস্থ রাজনীতির পুরোধা, গণ মানুষের অত্যন্ত প্রিয়নেতা আবদুল মান্নান ভূঁইয়া তাঁর লক্ষ লক্ষ ভক্ত ও অনুসারীকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁরই প্রতিষ্ঠিত শিবপুর শহীদ আসাদ কলেজের মাঠে সর্বশেষ অনুষ্ঠিত জানাজায় পাঁচ লক্ষাধিক লোকের সমাগম ঘটে। জানাজায় উপস্থিত অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ লোকের মতে কোন জানাজার নামাজে এত বিপুল সংখ্যক লোকের সমাগম তারা আর কখনও দেখেননি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, বিভিন্ন পেশার লোকজন, তাঁর ভক্ত-অনুরাগী, কৃষক-শ্রমিক সহ সব বয়সের জনগণের ভালবাসায় সিক্ত হলেন অন্তিম শয়ানে আবদুল মান্নান ভূঁইয়া। এ থেকেই বলা যায় বাংলাদেশের গণ মানুষের অনেকেরই হৃদয়ে স্থান করে নিতে পেরেছিলেন আবদুল মান্নান ভূঁইয়া ।
লক্ষ লক্ষ লোকের হৃদয়ে ঠাঁই পাওয়া খুব সহজ কাজ নয়, অনেক রাজনৈতিক নেতা জীবনভর রাজনীতি করেও খুব স্বল্প সংখ্যক জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেতেও তেমন একটা সুবিধা করে উঠতে পারেননি। মান্নান ভূঁইয়া এ ক্ষেত্রে এক বিরাট ব্যতিক্রম। এর কারণ তিনি জীবনভর গণ মানুষের কল্যাণের জন্য রাজনীতি করেছেন, রাজনীতিকে সত্যিকার অর্থেই তাঁর জীবনের আরাধ্য হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন ।
নরসিংদী জেলার শিবপুর উপজেলার মাছিমপুর গ্রামের এক কৃষক পরিবারে মান্নান ভূঁইয়ার জন্ম। দুলালপুর স্কুল, শিবপুর হাই স্কুল ও নরসিংদী কলেজে লেখাপড়ার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে মাস্টার্স ডিগ্রী লাভ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার সময় তিনি প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতির সংস্পর্শে আসেন। ঐ সময় দেশের ছাত্র সমাজের বৃহৎ অংশ সমাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও ঔপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে ছাত্র ইউনিয়নের ব্যানারে সংগ্রাম করছিলো। আবদুল মান্নান ভূঁইয়া ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতা ও পরে ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপের) সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন ।

১৯৬২-এর শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলনের সময় স্কুলের ছাত্র থাকার সময়ই মান্নান ভাইয়ের প্রগতিশীল রাজনীতির সংস্পর্শে আসি আমরা। প্রথম দিকে তাঁরই নির্দেশনায় আমরা শিবপুর ও আশে-পাশের অঞ্চলে ছাত্র ইউনিয়নের সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত করার কাজে নিয়োজিত থাকি । এ সময় আসাদ ভাই (ঊনসত্তরের গণ আন্দোলনে শহীদ), আমি, তোফাজ্জল হোসেন ভূঁইয়া, আবুল হারিছ রিকাবদার (কালা মিঞা), তোফাজ্জল হোসেন, ঝিনুক খান, আব্দুল মান্নান খান, আওলাদ হোসেন খান সহ আমরা সবাই চিন্তা, চেতনা ও বিশ্বাসে সুদৃঢ় থেকে একই সঙ্গে কাজ করেছি। ৬২-এর শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলন থেকে ৬৯-এর গণ আন্দোলন পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলন ও সংগ্রামে আমরা একসাথে কাজ করে ঐ অঞ্চলে সংগঠনকে বেশ মজবুত ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে সক্ষম হই । মান্নান ভাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা শেষ করে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁরই নির্দেশে শিবপুর অঞ্চলে কৃষকদের সংগঠিত করার কাজে ব্রতী হন। ছাত্র রাজনীতির পর তিনি কৃষক আন্দোলনে সরাসরি জড়িত হয়ে পড়েন। ছাত্র-যুব কর্মী হিসেবে আমরা সবাই মান্নান ভাইয়ের সঙ্গে ছাত্র ইউনিয়নের পাশাপাশি কৃষক সমিতির কাজেও সময় দিতে থাকি । কৃষক পরিবারে জন্ম ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত গ্রামীণ পরিবেশে বেড়ে উঠার কারণে কৃষকদের দুঃখ দুর্দশা ও সমস্যার কথা খুব ভালভাবেই বুঝতে পারতেন মান্নান ভাই। খুবই সাধারণ একজন কৃষকের সঙ্গেও খুবই আপন হয়ে তিনি মিশতে পারতেন বলেই ধীরে ধীরে গণ মানুষের হৃদয়ে তাঁর স্থান দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হতে থাকে। কৃষকদের সংগঠিত করার জন্য আন্দোলন, সংগ্রাম ছাড়াও বিভিন্ন বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ড সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নাটক, ফুটবল খেলা প্রভৃতিতেও কৃষকদেরকে সম্পৃক্ত করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় শিবপুর অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামে কৃষক সমিতির সংগঠন ও শিবপুরে কৃষক সমিতির একটি স্থায়ী অফিস প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়। আমরা কৃষকদেরকে এতটাই উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হই যে, তাঁরা স্বত্বঃপ্রণোদিত হয়ে সংগঠনের কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য উৎপাদিত ফসল বিশেষ করে ধান, পাট ও বাঁশ দিয়ে সাহায্য করতো। মাটি ও মানুষের খুব কাছাকাছি পৌঁছাতে না পারলে এ ধরনের কর্মকাণ্ড চালানো খুবই কঠিন ।
মান্নান ভাইয়ের একটি অদ্ভুত গুন ছিলো তিনি সমবয়সী, বয়সে তরুন কিংবা বয়োজ্যেষ্ঠ সবার সঙ্গেই আপনভাবে মিশতে পারতেন। তাই ঐ অঞ্চলের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী প্রবীণ ব্যক্তিরও সমর্থন ও সহযোগিতা পেয়েছেন তিনি। তাঁদের অনেকেই এখন প্রয়াত- মরহুম রব খাঁ, মরহুম বশির উদ্দিন খান, মরহুম রায়হান উদ্দিন, মরহুম মোজাম্মেল হোসেন, বজলুর রহমান রিকাবদার সহ আরও অনেকেই মান্নান ভাইয়ের রাজনৈতিক কর্মকান্ডে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করতেন।
১৯৬৮-এর শেষদিকে মওলানা ভাসানী আয়ূব-মোনেম শাহীর বিরুদ্ধে সংগ্রামকে তীব্রতর করার আহ্বান জানান। লাটভবন ঘেরাও ও ঢাকা শহরে একটি সর্বাত্মক হরতাল পালনের মাধ্যমে আন্দোলন বেগবান হয়। এরপর ২৯ নভেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র হাট-বাজার হরতালের ডাকের মাধ্যমে ভাসানী আন্দোলনকে গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেন। এই আন্দোলনে তহশীল অফিস ঘেরাও, স্থানীয় টাউট বাটপার এবং দূর্নীতিবাজ সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলারও আহ্বান জানানো হয়। এই আহ্বানে শিবপুরের কৃষক সমাজসহ সাধারণ জনগণ বেশ উদ্বুদ্ধ হয়। ইতিমধ্যেই মান্নান ভাই ও আসাদ ভাইয়ের নেতৃত্বে আমাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় শিবপুর ও চারিপাশের বিরাট অঞ্চলজুড়ে কৃষক সমিতির সংগঠন গড়ে উঠেছে।

২৯ ডিসেম্বর ছিলো রোববার। ঐ অঞ্চলে রোববারের প্রধান হাট হাতিরদিয়া (শিবপুর থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার উত্তরে)। তাই হাতিরদিয়ায় হরতাল ডাকা হয়। হাতিরদিয়ায় সর্বাত্মক হরতাল পালনের এক পর্যায়ে পুলিশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে। এতে জনসাধারণ দারুণভাবে বিক্ষুব্ধ হয়ে গ্রেপ্তারকৃতদের ছাড়িয়ে আনতে যায়। পুলিশ নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। পুলিশের গুলিতে সিদ্দিকুর রহমান, মিয়াচান, চেরাগ আলী ও হাসান আলী এই চারজন কৃষক শহীদ হন, আর আসাদ ভাই সহ বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মী আহত হয় ।হাতিরদিয়ার ঘটনা সংবাদমাধ্যমে আসার পর দেশব্যাপী প্রতিবাদ ও আন্দোলন জোরদার হতে থাকে। আর আসাদ ভাইকে প্রধান অভিযুক্ত করে মামলা রুজু করা হয়। মান্নান ভাই তখন মনোহরদী কলেজে শিক্ষকতার পাশাপাশি সাংগঠনিক কাজে সারাক্ষনই ব্যস্ত। ড. আবু মাহমুদের ওপর এন.এস.এফ-এর গুণ্ডাবাহিনীর আক্রমণ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে তাণ্ডবের কারণে তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনির্দিষ্টকাল ছুটি। আমিও তখন কিছুদিন মান্নান ভাইয়ের সঙ্গে মনোহরদী কলেজে শিক্ষকতা করেছি। হাতিরদিয়ায় কৃষক হত্যা ও পরবর্তী পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে হাতিরদিয়া ও শিবপুরে জনসভার ঘোষনা দেন মওলানা ভাসানী । মান্নান ভাই দিনরাত পরিশ্রম করে সবার সহযোগিতায় দু’টি জনসভারই প্রস্তুতিমূলক কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। সভার দিন শিবপুরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়, সভাস্থলের চারপাশে পুলিশ বেষ্টনী গড়ে তোলা হয় এবং বিভিন্ন স্থানে বাধা দেওয়া হয় যাতে জনগণ সভাস্থলে না আসতে পারে। সেদিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে শিবপুরে বিশাল কৃষক জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছিলো মান্নান ভাইয়ের সাংগঠনিক দক্ষতার ফলেই।

১৯৬৯-এর জানুয়ারীর প্রথম দিক থেকেই দেশের ছাত্রসমাজ আয়ূব স্বৈরশাসন উৎখাতের জন্য আন্দোলনকে দিন দিনই বেগবান ও বিস্তৃত করছিলো। ২০ জানুয়ারী ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে মিছিলে থাকা অবস্থায় পুলিশের টার্গেটেড গুলিতে শহীদ হন মান্নান ভাইয়ের সহযোদ্ধা, শিবপুরের কৃষক আন্দোলনের নেতা আসাদুজ্জামান, আমাদের আসাদ ভাই ।
শহীদ আসাদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে উনসত্তরের ছাত্র আন্দোলন ছাত্র গণআন্দোলনে রূপ নেয় এবং এর ফলে শেষে আয়ূব শাহীর পতন ঘটে। একথা বলতে দ্বিধা নেই যে, ১৯৬৯-এর ছাত্র- গণআন্দোলন আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণার অন্যতম উৎস।বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে দেশের প্রতিটি অঞ্চলের প্রায় সব জনগণের অংশগ্রহণ ও ত্যাগ তিতিক্ষার কথা ইতিহাসের পাতায় যুগ যুগ ধরে শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে সমুজ্জল হয়ে থাকবে। ঐ সময় দেশের অভ্যন্তরে কিছু কিছু অঞ্চলের প্রতিরোধের কথা অন্যান্য অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস ও প্রেরণা যুগিয়েছে। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর টাঙ্গাইল অঞ্চল এবং মান্নান ভূঁইয়ার শিবপুরের নাম ইতিহাসের পাতায় বেশ উজ্জ্বল। কৃষক আন্দোলন ও গ্রগতিশীল রাজনৈতিক আন্দোলনের পীঠস্থান শিবপুর মুক্তিযুদ্ধকালীন নয় মাসের বেশীরভাগ সময়ই হানাদারমুক্ত ছিলো এবং ঐ অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধারা দেশের অভ্যন্তরে মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে যুদ্ধ করেছে। তারা হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি সফল যুদ্ধে অশগ্রহণ করেছে।
স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে শিবপুরের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার সঙ্গে আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার নাম আঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাঁরই নেতৃত্বে শিবপুরে গড়ে উঠে জনপ্রতিরোধ। মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিঝরা দিনগুলোতে শিবপুরকে কেন্দ্র করে ঐ অঞ্চলের জনগণ ও দেশের তৎকালীন প্রগতিশীল ছাত্র-যুব ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের একটি বড় অংশ প্রতিরোধের দূর্গ গড়ে তোলে। এই প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ গ্রহণের জন্য অনেকেই এসেছিলেন শিবপুরে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য কাজী জাফর আহমেদ, মোস্তফা জামাল হায়দার, হায়দার আকবর খান রনো, হায়দার আনোয়ার খান জুনো, আতিকুর রহমান সালু, কাজী শাহরিয়ার আক্তার বুলু, হাজেরা সুলতানা সহ অনেকেই ছুটে এসেছিলেন মান্নান ভূঁইয়ার ঘাটি শিবপুর অঞ্চলে।

মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে কিছু দিনের জন্য ভারতের আগরতলায় গিয়েছিলেন মান্নান ভাই । অল্প কিছুদিন থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন মুক্তিযুদ্ধ সংগঠন করতে হবে দেশের অভ্যন্তরে মুক্তঅঞ্চল গঠন করেই। তিনি ফিরে এসে শিবপুরে ছাত্র-যুবক, কৃষক তথা সর্বস্তরের জনগণের সম্পৃক্ততার মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এক বিরাট মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলতে সক্ষম হন। মান্নান ভূঁইয়ার সহযোদ্ধা বীর মুক্তিযোদ্ধা মজনু মৃধা ও নেভাল সিরাজ হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি সফল যুদ্ধে আশ গ্রহন করেছিলেন। শিবপুরের মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে ঐ অঞ্চলের যে সব প্রগতিশীল কর্মী মান্নান ভূঁইয়াকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন তাদের ভেতর রব খাঁ, আওলাদ হোসেন, ঝিনুক, আব্দুল আলী মৃধা, কাঞ্চন, কালা মিঞা, তোফাজ্জল, রশীদ মোল্লা, সেন্টু, শহীদ ভূঁইয়া এদের নাম উল্লেখযোগ্য।
স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে মান্নান ভূঁইয়ার গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার জন্য তিনি জনগণের হৃদয়ে তাঁর স্থান আরও সুদৃঢ় করতে সক্ষম হন। যে আশা আকাংখা নিয়ে এদেশের জনগণ মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলো স্বাধীনতার পর তা পূরণ হওয়ায় কোন লক্ষনই দেখা যাচ্ছিল না- বিশেষ করে কৃষক-শ্রমিক সহ সাধারণ মানুষের জীবনে উন্নতির পরিবর্তে তাদের স্বাভাবিক জীবনধারণই ক্রমে ক্রমে বেশ কঠিন হয়ে পড়ছিলো। এ অবস্থায় ১৯৭৩ সালে শিবপুরে মওলানা ভাসানীর নির্দেশে তিনদিন ব্যাপী এক জাতীয় কৃষক সম্মেলনের আয়োজন করেন মান্নান ভূঁইয়া। স্বাধীনতার পর খুব সম্ভবত বিরোধী দলের এত বড় সম্মেলন ও কর্মশালা দেশের আর কোথাও অনুষ্ঠিত হয়নি। শিবপুর অঞ্চলে মান্নান ভূঁইয়ার শক্তিশালী সংগঠন ও আপামর জনসাধারণের মাঝে গ্রহণযোগ্যতার জন্যই এটি সম্ভব হয়েছিলো ।
১৯৮৬ সনে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে আদর্শ গ্রাম গড়ে তোলার কার্যক্রম হাতে নেন। ঐ বছরের শেষদিকে শিবপুর শহীদ আসাদ কলেজ মাঠে মান্নান ভাইয়ের সহযোগিতায় লক্ষাধিক লোকের এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। মান্নান ভাই তাঁর প্রিয় রাজনৈতিক সহকর্মী ও সহযোদ্ধা আসাদ ভাইয়ের শাহাদাতের পর শিবপুর শহীদ আসাদ কলেজ প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর অন্তিমশয়ানও হয়েছে এই কলেজ মাঠের লাগোয়া তাঁর বাসভবন প্রাঙ্গণে ।
১৯৯৭-এর ৩০ এপ্রিল আবারও মান্নান ভূঁইয়া শহীদ আসাদ কলেজ মাঠে এক বিশাল কৃষক সমাবেশের আয়োজন করেন। তখন তিনি বিএনপির মহাসচিব। দৈনিক দিনকালের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক কাজী সিরাজ ১৯৯৭ সালের ৩ মে ‘কৃষকের পদভারে চঞ্চল শিবপুর শীর্ষক নিবন্ধে লিখেছিলেন- “সকলের চোখে মুখে ছিলো যেন সূর্য থেকে বজ্র কেড়ে আনার অটল প্রতিজ্ঞা । সমবেত লাখো মানুষের চোখের তারায়ও দেখেছি সেই একই প্রতিজ্ঞার প্রতিচ্ছবি- যে ছবি প্রতিচ্ছবি দেখেছিলাম প্রায় তিন দশক আগে এই শিবপুরের ঘাটিতে। একাত্তরে শিবপুরের জনগণের মাঝে ছিলো মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে স্বাধীনতার সোনালী সূর্যকে ছিনিয়ে আনার অটল প্রতিজ্ঞা আর আজও আছে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার দৃপ্ত শপথ। ”

২০০১ সালের ৩০ মার্চ স্বাধীনতার ৩০ বছর পূর্তি উপলক্ষে শিবপুরে মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের এক পূনর্মিলনীর প্রথম পর্ব অনুষ্ঠিত হয় সকালে শিবপুর পাইলট স্কুল মাঠে এবং বিকেলে মুক্তিযোদ্ধা জনতা সমাবেশ হয় টিডিসি মাঠে। উভয় অনুষ্ঠানে আমি বক্তব্য দিয়েছিলাম। বিকেলের সমাবেশে মান্নান ভূঁইয়া বলেছিলেন- “সুষ্ঠ ও অবাধ নির্বাচন হলে বিএনপি এককভাবে ২০০ আসন এবং জোটগতভাবে ২৫০ আসন পাবে।” [যুগান্তর ৩১ মার্চ ২০০১] পরদিন বিএনপি’র প্রথম সারির কিছু নেতা এবং চারদলীয় জোটের সমর্থক কোন কোন পত্রিকায় মান্নান ভাইয়ের এই বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করে বলে “মান্নান ভূঁইয়া এই দৈব বাণী কি করে পেলো?” তবে ইতিহাস স্বাক্ষী- ২০০১ সালের নির্বাচনে চারদলীয় ঐক্যজোট দুই তৃতীয়াংশের বেশী আসনে জয়লাভ করেছিলো। মান্নান ভূঁইয়া গণ মানুষের নেতা ছিলেন বলেই সবসময় জনগণের হৃদয়ের স্পন্দন অনুভব করতে পারতেন, এ জন্যই তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী পুরোপুরি সঠিক হয়েছিলো । মান্নান ভাইকে খুব কাছে থেকে দেখেছি ১৯৬০-এর দশকের প্রথম দিক থেকে তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। তিনি এগারো বছরের বেশী বিএনপি’র মহাসচিবের দায়িত্ব অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে পালন করেছেন। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছেন খুবই সফলভাবে। মিডিয়া তাঁকে “ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট মিনিস্টার” হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলো। তিনি সৎ ও নিবেদিত প্রাণ রাজনৈতিক নেতা হিসেবে জনগণের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারী বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক মহাদুর্যোগ নেমে আসে। গণ মানুষের নেতা মান্নান ভূঁইয়া এই দূর্যোগের সময় রাজনীতিতে সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে বাংলাদেশের রাজনীতিকে “দুবৃত্তায়নের” হাত থেকে মুক্ত করতে হবে, নিবেদিত প্রাণ রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের মূল্যায়ন করতে হবে আর পারিবারিক উত্তরাধিকারের পরিবর্তে রাজনৈতিক উত্তরাধিকারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তাঁর এই অগ্রসরমান ও প্রগতিশীল চিন্তার সম্যক উপলব্ধি অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয়নি। মৃত্যুর আগে বেশ কিছুদিন তিনি দুরারোগ্য ব্যধি ক্যান্সারে ভুগছিলেন। রাজনীতিতে সুস্থ ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য উৎকণ্ঠিত ছিলেন ।
মান্নান ভাই জীবন-ভর খুবই সাধারণ জীবন যাপন করেছেন। যে কেউ যে কোন সমস্যা নিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারতেন। অনেক দিন খুব ভোর বা বেশ রাতেও তাঁর এলাকার খুবই সাধারণ লোককে মন্ত্রীর বাসভবনে মান্নান ভাইয়ের সাথে স্বাক্ষাৎ করে তাদের সমস্যা সম্পর্কে আলাপ করতে দেখেছি। বাংলাদেশের আর কোন এত বড় মাপের রাজনৈতিক নেতা কিংবা মন্ত্রীর সঙ্গে সাধারণ জনগণ মিশতে পারে কিনা তা আমার জানা নেই। এ জন্যই মান্নান ভূঁইয়া সত্যিকার অর্থেই গণ মানুষের প্রিয় নেতায় পরিণত হয়েছিলেন ।
প্রয়াত কারও প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে তাঁর আদর্শকে ধারণ করা ও ব্যাপকভাবে প্রচারের ব্যবস্থা করা। গণমানুষের প্রিয় নেতা মান্নান ভূঁইয়ার জীবনের অন্তিম ইচ্ছা বাংলাদেশের রাজনীতিকে দুবৃত্তায়নের কবল থেকে মুক্ত করার প্রচেষ্টায় নিবেদিত প্রাণ রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের এগিয়ে আসা সময়ের দাবী।

লেখক: সাবেক উপাচার্য
জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় ও আহ্বায়ক মান্নান ভূঁইয়া পরিষদ


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category