গল্প : নেয়ামত উল্লাহ
♦নুরুল ইসলাম নূরচান♦
এখন ভাদ্র মাস। যখন তখনই বৃষ্টি হয়। তাই রিক্সার প্যাসেঞ্জার খুব কম। অনেকে অটোরিকশা, সিএনজিতে চলে যায়। যাত্রীর জন্য অনেকক্ষণ যাবৎ অপেক্ষা করছেন আছর আলী।
: আসসালামু আলাইকুম, আপনি কেমন আছেন?
: অলাইকুম আসসালাম, আসসালামু আলাইকুম, ভালো আছি স্যার, আপনি কেমন আছেন?
: আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। গাবতলী যাবেন?
: হ, যামু।
আছর আলী একজন রিক্সা চালক। সে রিক্সা চালায় আট দশ বছর ধরে। এই পর্যন্ত তাকে কোন প্যাসেঞ্জার সালাম দেয়নি। তাই এঘটনায় সে অবাক হল। পরক্ষণে সে ভাবলো, আসলে শ্রমজীবী মানুষের জীবনে অবাক আর সবাক হওয়ার মত ঘটনাগুলো না ঘটাই উচিত।
রিক্সার গদিটা মুছে দিয়ে আছর আলী বলল, উঠেন স্যার, উঠে বসেন।
রিক্সা চলছে।
: আচ্ছা স্যার একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
: অবশ্যই বলেন, কী বলতে চান?
: রিক্সায়ালাদেরকে তো কোন প্যাসেঞ্জার সালাম দেয় না, কিন্তু আপনি দিলেন। তাছাড়া বয়সে আমি আপনার কিছু ছোট হব।
: কেন রিক্সাওয়ালা কী মানুষ না, তাছাড়া সালাম দেওয়া ছোট বড়র সাথে প্রশ্ন নেই।
: আপনার কথা শুনে খুব খুশি হইলাম। কিন্তু অনেকে সালাম তো দূরের কথা, তুই তুমি করে ডাকে, কেউ কেউ ডাকে রিক্সাওয়ালা বলে।
: তখন কী আপনি খুব কষ্ট পান?
: না, স্যার। কষ্ট পাওয়ার কি আছে, যার যা ইচ্ছা তাই ডাকোক, আসলেই তো আমি রিক্সাওয়ালা।
: আসলে কী জানেন, শ্রমজীবী মানুষকে ছোট করে দেখা উচিত না। কারণ, আপনারাই দেশের চালিকাশক্তি, প্রবাসী এবং দেশে উৎপাদনের সাথে যারা জড়িত তাদেরকে যথাযথ সম্মান করা উচিত। কারণ, এরা না থাকলে দেশ অচল হয়ে পড়বে। খেটে খাওয়া মানুষদেরকেও অসম্মান করা ঠিক না, এই যে আপনি রিক্সা চালাচ্ছেন, আমাকে তো ২০ টাকা ভাড়ার জায়গায় এক হাজার টাকা ভাড়া দিলেও আমি রিকশা চালাতে পারবো না।
এ কথা শুনে আছর আলী খুশিতে একেবারে গলদ গলদ। বলল, স্যার আপনি কি করেন?
: আমি সরকারি একটি দপ্তরের একজন কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি, তারপরও থাকি একটি সাধারণ ঘরে, ডালভাত খেয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে বেঁচে আছি। আমার মত পোস্টে যারা চাকরি করেন তাদের প্রায় সকলেই নিজস্ব গাড়ি ছাড়া চলেন না। তাতে কিন্তু আমার কোন দুঃখবোধ হয় না। কোন দিন এক বিন্দু আফসোসও করেনি। কথার মোড় ঘুরিয়ে নেয়ামতুল্লাহ বললেন, আপনার বাড়িতে কে কে আছে, ছেলেমেয়ে কয়জন?
: স্ত্রী, এক ছেলে এক মেয়ে আছে স্যার।
: ছেলেমেয়েরা কী করেন?
: মেয়েটা বড়, সে এবার অনার্স তৃতীয় বর্ষে, ছেলেটা এইচএসসি প্রথম বর্ষে।
: বলেন কী আপনি রিক্সা চালিয়ে তাদের খরচা বহন করতে পারেন!
: মোটামুটিভাবে পারি স্যার,তবে এখন আর তাদের পড়াশোনার খরচের চাপ আমার উপর খুব বেশি পড়ে না। কারণ, ছেলে-মেয়ে দুজনই টিউশনি করে চালাতে পারে। সময় সময় আমার কাছ থেকেও নেয়।
: আল্লাহ আপনাকে খুব ভালো রেখেছেন, আপনার জন্য অনেক অনেক দোয়া রইল, আপনার ছেলে মেয়েরা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যেন আপনার দুঃখ ঘুছিয়ে দেয়।
তারা দুজনে সুখ দুঃখের কথা বলতে বলতে রিক্সা স্টেশনে চলে এসেছে। তাই নেয়ামত উল্লাহ বললেন, এখানেই থামান রিক্সা, আমি এখানে নামবো। আসেন দুজনে মিলে এক কাপ রং চা খাই।
আছর আলী রিক্সা স্টেনের এক জায়গায় নিয়ে রাখল। তারপর দুজনে মিলে চা খেতে বসল চা দোকানে।
: আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
: স্যার আমাকে ধন্যবাদ দিলেন কেন!
: আপনি কষ্ট করে আমাকে নিয়ে এসেছেন, তাই।
: আপনাকে নিয়ে আসার জন্য তো আমাকে ভাড়াই দেবেন!
: হ্যাঁ দেবো, এতে করে তো আমার মান সম্মান নষ্ট হয়নি।
: আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ স্যার।
সালাম বিনিময়ের পর রিক্সা ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে নেয়ামতুল্লাহ চলে গেলেন বাড়ির দিকে।
আছর আলী ভাবনায় পড়ে গেল, এমন মানুষ এখনো দেশে আছে! আসলে তিনি মানুষ নন, ফেরেশতার মত।
লেখক : সম্পাদক, কবি ও লেখক.