ড. প্রিয়দর্শী মজুমদার এবং অধ্যাপক সন্দীপ দে
(উভয়েই শিক্ষা সমালোচক, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক এবং পশ্চিমবঙ্গের বারাকপুর রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ কলেজের ইলেকট্রনিক বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক)
—————————————————
পাবলিশিং হাউস সংক্রান্ত ব্যবসা একটি বেশ বড় মাপের উদ্যোগের মধ্যে পরে| এই ধরণের ব্যবসাকে বড় করতে যথেষ্ট ধৈর্য লাগে আর সময় দিতে হয়| সাধারণত দেখা যায় অনেকক্ষেত্রেই পুস্তক ব্যবসায়ীদের এই সংক্রান্ত ব্যবসার একটি পারিবারিক ঐতিহ্য থাকে, আবার কখনো কোনো সফল উদ্যোগপতি একাই তাঁর অধ্যাবসায়ের জোরে চটজলদি পুস্তক ব্যবসা দাঁড় করিয়ে ফেলেন| যদি কেউ সফল পুস্তক ব্যবসায়ী হতে চান তাহলে তাঁদের প্রথমেই ঠিক করতে হবে কি ধরণের বই নিয়ে আপনারা এগোতে চান, পাঠ্যপুস্তক নাকি অন্যান্য পুস্তক (গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ বা কবিতার বই, ভ্রমণ কাহিনী ইত্যাদি)| নিজস্ব প্রকাশনী সংস্থা খোলার আগে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা জরুরি| কিছু কিছু প্রকাশনা সংস্থা দুই ধরণের পুস্তক নিয়েই ব্যবসা করে থাকেন (তবে পুরোটাই নির্ভর করছে ব্যবসায়িক মূলধন, যোগ্য লেখকদের সাথে যোগাযোগ ও সঠিক মার্কেটিং স্ট্রাটেজির উপর)| কোনো লেখকের সাথে নতুন কোনো বইয়ের চুক্তি করার আগেই সংশ্লিষ্ট বইয়ের মার্কেট কেমন হতে পারে সেটি পর্যালোচনা করে নেওয়া জরুরি| যেকোনো পাবলিশিং হাউসেরই মূল ভূমিকায় থাকেন সেই সংস্থাটির সম্পাদক বা এডিটর| যদি বইটি পাঠ্যপুস্তক হয় তবে এক্ষেত্রে লেখকের থেকে আসন্ন বইটির একটি নমুনা পরিচ্ছেদ সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের থেকে সেই লেখাটির গুণগত মান পর্যালোচনা করিয়ে নেওয়া বাঞ্চনীয়| আর যদি বইটি পাঠ্যপুস্তক না হয় সেক্ষেত্রে সম্পাদককেই অনেকটা দায়িত্ব ও ঝুঁকি নিয়ে বইটি প্রকাশের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে| বইটি প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেবার পরবর্তী ধাপের কাজ বইটিকে সঠিকভাবে কম্পোজ করা| লেখক নিজেই যদি পাণ্ডুলিপির সফ্ট কপি দিয়ে দেন তাহলে এক্ষেত্রে সম্পাদকের ঝামেলা তুলনামূলক ভাবে কম| নইলে ডি.টি.পি. অপারেটরকে দিয়ে হাতে লেখা পাণ্ডুলিপির পুরোটাই সফ্ট কপি করিয়ে নিতে হবে| বইটি যদি বিজ্ঞানভিত্তিক হয় এবং গাণিতিক ফর্মুলা থাকে সেক্ষেত্রে বিজ্ঞানের সাথে একদমই যোগাযোগ না থাকা ডি.টি.পি. অপারেটরের পক্ষে এই ধরণের বই নির্ভুলভাবে টাইপ করা খুবই সমস্যাজনক| এই দিকে সচেতনতা জরুরি কারণ নির্ভুল বই টাইপ করতে যদি অনেক সময় লেগে যায় অথবা ছাপা বইতে অসংখ্য ভুল থেকে গেলে শুরুতেই সেই পাবলিকেশন-এর বদনাম হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়| ডি.টি.পি.-এর কাজের সাথে সাথেই বইতে যদি কোনো ড্রয়িং থাকে সেগুলি এবং বইয়ের প্রচ্ছদ, লেআউট এবং ইমেজ কম্পোজিং এই কাজগুলো কোনো গুণগত মানের শিল্পীকে দিয়ে করিয়ে নেওয়া জরুরি| শুরুতেই এই ধরণের কাজগুলির জন্য কোনো স্থায়ী কর্মী নিয়োগ না করে প্রয়োজনমতো আউটসোর্সইং করিয়ে নেওয়া যেতে পারে| বই টাইপিং-এর কাজ সম্পূর্ণ হলে অবশ্যই প্রুফ রিডিং-এর কাজটি এবার করতে হবে| এই কাজটি সাধারণত সংশ্লিষ্ট লেখক, সম্পাদক নিজে বা প্রুফ রিডাররা করে থাকেন| যতক্ষন না পর্যন্ত বইটি সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত হচ্ছে ততক্ষন পর্যন্ত পরপর সাইকেল-এ প্রুফ চেকিং জরুরি| ত্রুটিমুক্ত বই সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হবার পরের ধাপ ফাইনাল প্রিন্টিং এবং বাইন্ডিং (এক্ষেত্রেও আউটসোর্সিং করাই যায়)| প্রিন্টেড বই হাতে চলে আসার পরই আসল কাজ শুরু| কারণ এতক্ষন ধরে যা হয়েছে তা শুধুই বিনিয়োগ, এবার পালা সেই বিনিয়োগ এবং লভ্যাংশ ঘরে তোলার| একজন নতুন পাবলিশার-এর পক্ষে শুধুমাত্র খুচরো বিক্রির উপর ভরসা করে ব্যবসা চালানো সমস্যাজনক| এক্ষেত্রে খুচরো বিক্রির পাশাপাশি পাইকারি বিক্রির উপরও জোর দিতে হবে| যদি বইটি কোনো পাঠ্যপুস্তক হয় তবে সেই সংক্রান্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক এবং গ্রন্থাগারিকদের সাথে বই-এর কপি সহ নিরন্তর যোগাযোগ করা জরুরি| যতটা পারা যায়, বৃহৎ এলাকা জুড়ে এই ধরণের মার্কেটিং বা প্রচার প্রয়োজন| বিভিন্ন সরকারি/বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির গ্রন্থাগারে বা ব্যক্তিগত মালিকানাধীন/ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের বাধ্যতামূলক ক্রয়ের মাধ্যমে পাঠ্যপুস্তকের পাইকারি বিক্রির ভিত্তি তৈরী করা যায়| তবে এই পদ্ধতিতে সাফল্য লাভের জন্য যথেষ্টই ঘাম ঝরাতে হবে| কোনো পাঠ্যপুস্তক যদি গুণগত ভাবে উৎকর্ষমূলক হয় এবং সবার মধ্যে পরিচিতি পেয়ে যায় তবে পাইকারি বিক্রির পাশাপাশি অনলাইন ই-কমার্স সাইট এবং বিভিন্ন বইয়ের দোকান থেকেও সরাসরি বিক্রি হবে| এর জন্য পাবলিশারকে বিবিধ পুস্তক বিপনী এবং ই-কমার্স সাইটগুলির সাথে যোগাযোগ করতে হবে| এই পদ্ধতির পোশাকি নাম বি২বি| পাইকারি এবং বি২বি-এর পাশাপাশি পাবলিশিং হাউস এর অফিস, ওয়েবসাইট বা নিজস্ব বিপনী থেকেও বইয়ের খুচরো বিক্রি হতেই পারে| বইটি পাঠ্যপুস্তক না হলে এক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাইকারি বিক্রি ছাড়া বাকি দুটি পদ্ধতি অবলম্বন করে বই বিক্রি করা সম্ভব তাছাড়াও বিভিন্ন পাবলিক/ ডিস্ট্রিক্ট লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষের সাথেও যোগাযোগ করা যেতে পারে| এই ধরণের বইয়ের পরিচিতির জন্য বিবিধ পুস্তকমেলায় বইটির প্রদর্শন এবং ডিজিটাল মার্কেটিং খুবই ভালো উপায়| সব ধরণের বইয়ের ক্ষেত্রেই লেখক/ সম্পাদক নিজস্ব পরিচিতি মহলেও বইটির প্রচার করতে পারেন| যেকোনো ব্যবসারই মূল কথা সাহস, দক্ষতা, ঝুঁকি নেওয়ার এবং বিনিয়োগ ক্ষমতা, বইয়ের ব্যবসার ক্ষেত্রেও তাই| হয়তো আপনার তৈরী পাবলিশিং হাউস-এর প্রথম দিকের কিছু বই তেমন বাজার পেলোনা, কিন্তু তবুও সাহস হারালে চলবে না, আপনাদের লেগে থাকতে হবে, তাহলে জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো এই ক্ষেত্রেও সাফল্য আসবেই| আপনার হাউস থেকে কোনো একটি বা দুটি বই দাঁড়িয়ে গেলেই ধীরে ধীরে আপনি এই ব্যবসায় জায়গা করে নিতে পারবেন| কি ভাবছেন? ঝুঁকি নিয়ে দেখবেন নাকি?