শহীদ আসাদ
নূরুদ্দীন দরজী
কিছু কিছু মৃত্যু জাতি ও জাতির মানুষকে হাতছানি দিয়ে যায়। নিজেদের চিনতে শেখায়। মাতৃভূমির লাঞ্চনার অবসানে মানুষ উদ্ধুদ্ধ হয়। বাঙালি জাতির এমনি এক উর্বর সন্তান ছিলেন মোহাম্মদ আমানুল্লাহ আসাদ। ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি আসাদকে হত্যা করা হয় । তিনি শহীদ হন। জাতির স্বাধীকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর এ আত্মত্যাগ। সেদিন তাঁর রক্ত অগ্নিশিখা হয়ে অবহেলিত বাঙালি জাতির ধমনীতে তীর্যক জাগরণ সৃষ্টি করেছিলো। জাতিকে মুক্তির পথ দেখিয়েছে। পরাধীনতার গ্লানি মুছে দিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে । শহীদ আসাদ ছিলেন এক আত্মত্যাগী বীর, জাতিকে জাগিয়ে তোলার অন্যতম অগ্রদূত। তাঁর টগবগে রক্তস্রোতে ভেসে বাঙালি জাতি ঝাপিয়ে পড়েছিলো হানাদার পাকিস্তান বাহিনীকে চিরতরে বাংলার মাটি থেকে বিদায় করতে। তাদের শোষণ বঞ্চনা থেকে মুক্ত হতে।বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষের জন্য আসাদের ছিলো অফুরন্ত ভালোবাসা, আর সীমাহীন দরদ। আসাদ ভাবতেন জাতির পরাধীনতার জিঞ্জিরে আবদ্ধের কথা। প্রায় দুইশত বছর ইংরেজ শোষণ শাসন বিশেষ করে ২৩ বছর পাকিস্তানের জুলুম নির্যাতনের যাঁতাকলে পিষ্ট বাঙালির দুর্দশা আসাদের মনে গভীর বেদনার ক্ষত সৃষ্টি করেছিলো।
১৯৪৭ সালে এ দেশ ব্রিটিশ মুক্ত হলে দেশীয় কিছু দোসরদের সহযোগিতায় পাকিস্তানীরা আমাদের গ্ৰাস করে করে নিঃস্ব করতে থাকে। সামরিক দুঃশাসক আইয়ুব খান অত্যাচারের ষ্টিমরোলার চালায়। দিনের পর দিন বাংলাদেশের মানুষ অবহেলিত ও বঞ্চিত হতে থাকে। আইয়ুব শাহীর বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছিলেন আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদ। নিজেদের অধিকার আদায়ে মানুষ ঘর ছেড়ে রাজপথে নেমে আসতে বাধ্য হয়। মিছিল, মিটিং ও শ্লোগানে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল প্রকম্পিত হয়ে উঠে। ঐ পরিস্থিতিতে ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি ঢাকায় দশ হাজার ছাত্রের এক বিরাট মিছিলের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছিলেন আসাদ। আর ঠিক তখনই আইয়ুব শাহীর পুলিশ বাহিনীর এক পাষান্ড মিছিলের অগ্রভাগে থাকা আসাদের বুকে গুলি করে তাঁকে হত্যা করে। তিনি লুটিয়ে পড়েন শ্যামল মাটিতে। বাংলা মায়ের এ বীর শহীদ হন। আসাদ শহীদ হওয়ার সংবাদ দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে সারা বাংলায়। তাঁর রক্ত সারা বাংলার আন্দোলন সংগ্রামের বীজ হয়ে রোপিত হয়। বাংলার মানুষ অগ্নি দুগ্ধ হয়ে উঠে। তাঁরা শপথ নেয় বজ্রকঠিন। বাংলা হয়ে পড়ে রণক্ষেত্র। মানুষ তাদের স্বাধীকার আদায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আইয়ুব খা ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা আর বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি। আন্দোলন বিস্ফোরিত হলে ২৪ জানুয়ারি আরেক বীর সন্তান মতিউরকে হত্যা করা হয়। বাংলা আর ও প্রজ্জ্বলিত হয়। হানাদারদের পালাতে হবে বুঝতে পারে। কিছু দিনের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু ষড়যন্ত্র মূলক আগরতলা থেকে মুক্তি পান। বঙ্গবন্ধুর আহবানে পরবর্তী মাত্র আড়াই বছরে সশস্ত্র যুদ্ধ মারত্মক রুপ নেয়।
২০ জানুয়ারির রক্তের তেজস্ক্রিয়তায় পাকিস্তানীরা ভয়ে আতংকিত ও দিশাহারা হয়ে যায়। এ দেশের সকল শ্রেণি পেশার মানুষ মাতৃভূমির মুক্তির জন্য আমরণ আন্দোলন সংগ্ৰামে ঝাঁপিয়ে পড়ে । সুভাষ বসুরর আজাদ হিন্দ ফৌজের ভয়ে ব্রিটিশরা যেমন ভারত তথা বাংলাদেশ ছেড়ে যেতে তাড়িত হয়েছিলো,তাদের ঘুম হারাম হয়েছিলো ঠিক তেমনটি আসাদের রক্ত মাখা অভ্যূত্থানে পাকিস্তানীরা বুঝে ফেলেছিলো এ দেশ ছাড়তে হবে। আসাদের রক্তদানের ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন আন্দোলন ও ৭১-এ সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের দেশ বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। বলতে গেলে আসাদের রক্তমাখা এ বাংলাদেশ।
আজ বাংলাদেশ মুক্ত স্বাধীন। এ দেশের আকাশে বাতাসে ভেসে বেড়ায় শহীদের রক্তের স্রোত। বাংলার মাটি শুকলে আসাদের রক্তের গন্ধ পাওয়া যায়। এ গন্ধ কোন দিন শেষ হবেনা। তাঁর রক্ত বাঙালির হৃদয় মন স্পন্দিত করবে চিরকাল,দিয়ে যাবে অগ্ৰিমন্ত্রের শপথ বাংলাদেশের জন্য।শহীদ আসাদ নামটি বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে নরসিংদীর সন্তান শহীদ আসাদ প্রসঙ্গে কথা অনায়াসে এসে যায়। যেমনটি বাংলা সাহিত্য আসে নরসিংদীর সন্তান কবি শামসুর রাহমান ও কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ।
আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন বর্ণবাদের করাল গ্ৰাস থেকে মানুষকে মুক্ত করতে জীবন দিয়ে পৃথিবীর বুকে অমর হয়ে আছেন। মার্টিন লুথার কিং একই কারণে দাসত্বের অবসান ঘটাতে জীবন উৎসর্গ করে ইতিহাস সৃষ্টি করে জীবন্ত রয়েছেন। আমেরিকার আরেক প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি সমাজে “সিভিল রাইটস,কে প্রতিষ্ঠায় বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। আর ও বলতে গেলে- নেলসন ম্যান্ডেলা বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্ৰামে করে কালোদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। পৃথিবীতে এমন আর ও অনেকের মত শহীদ আসাদ ও ৬৯-এ গণঅভ্যুত্থানে জীবন বিসর্জন দিয়ে স্বাধীনতার পথ সুগম করে গেছেন। । মাত্র ২৭ বছরের (১৯৪২-১৯৬৯) সময়ে জ্ঞান হবার পর থেকেই তিনি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। এলাকা তথা নরসিংদীর মানুষকে উদ্ধুদ্ধ করতেন। ব্যক্তিগত স্বাদ গন্ধ তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। তাঁর দৃঢ় অঙ্গীকার ছিলো এ দেশ ও দেশের মানুষকে অত্যাচারী বেনিয়াদের হাত থেকে যে কোন মূল্যে মুক্ত করবেন। জীবন দিয়ে তিনি দেশ মুক্তির মূল্য পরিশোধ করে গেছেন।
প্রতি বছর ২০ জানুয়ারি শহীদ আসাদ দিবস। যত দিন বাংলাদেশ থাকবে, বাংলার মানুষ বেচেঁ থাকবেন ততদিন আসাদ থাকবেন। থাকবেন আন্দোলন সংগ্ৰামের মূর্ত প্রতীক হয়ে। বাংলার আকাশে শহীদ আসাদ এক আলোক জ্যোতি। এ জ্যোতি সামনে নিয়ে আমরা পথ চলবো সকল কালে সব সময়ে।
২০ জানুয়ারি শহীদ আসাদ দিবসের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
।
লেখকঃ কবি,সাহিত্যিক, লেখক ও সাবেক উপজেলা শিক্ষা অফিসার।