• মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারী ২০২৫, ০৩:১৬ অপরাহ্ন

প্রবন্ধ : শিবপুরের ধানুয়ার ক্বারী বাড়ির ওরশ — লেখক নূরুদ্দীন দরজী

admin / ২২১ Time View
Update : বুধবার, ১ মার্চ, ২০২৩


নূরুদ্দীন দরজী :

প্রায় দেড় শতাব্দী কাল যাবৎ নরসিংদী জেলার শিবপুর উপজেলায় ধানুয়া গ্ৰামে একটি ওরশ পালিত হয়ে আসছে। এ ওরশ শরীফকে কেন্দ্র করে এখানে তিন দিন ব্যাপী মেলা ও বসে। এলাকার লোকজন এটিকে”ক্বারী বাড়ির ওরশ ও মেলা বলে থাকেন । আর এর আয়োজন করা হয় ধানুয়ায় ক্বারী গরীব‌উল্লাহ দরবার শরীফ প্রাঙ্গনে। এখানকার ওরশ ও মেলাকে ঘিরে সাজ সাজ রব পড়ে যায়। এলাকাটি লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। উৎসাহী মানুষ দিন গুনতে থাকে ক্বারী বাড়ির মেলা কবে কখন হবে। মানুষের নিকট এ আয়োজন প্রতি বছর‌ই স্বতন্ত্র আমেজ এনে দেয়। বাংলা ফাগুন মাসের ১৯ তারিখ মূল আয়োজনটি করা হয়ে থাকে। তবে চালু থাকে তিন দিন। মেলা প্রাঙ্গণ হয় জমজমাট।

দরবার শরীফের ঐতিহাসিক পটভূমিঃ এখানকার ওরশ ও দরবারের প্রতিষ্ঠাতা ক্বারী গরীবুল্লাহ। কথিত আছে ক্বারী গরীবুল্লাহ চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে ধানুয়া গ্ৰামে এসেছিলেন। গরীবুল্লাহর পৈত্রিক ঠিকানা বৃহত্তর ফরিদপুর জেলাধীন বর্তমান শরীয়তপুর জেলার দুপরীকান্দী গ্ৰামে। জানা যায় যে,মাত্র ৯ বছর বয়সে বালক গরীবুল্লাহ তাঁর পিতামাতাকে ছেড়ে আধ্যাত্বিক সাধনের পথে বের হয়ে যান। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেফিরে কি এক অদৃশ্য ইঙ্গিতে চলে আসেন তৎকালীন শিবপুর থানাধীন ধানুয়া গ্ৰামে। শরীয়তপুরের বাড়ি থেকে বের হ‌ওয়ার সময় তাঁর নিকট মাত্র ৫টি পয়সা ছিল। প্রথমে ঢাকায় আসার পর ঢাকার এক অলি তাঁর হাতের পয়সা ৫টি নিয়ে যান। ঢাকার অলি নিঃস্ব গরীবুল্লাহকে আশ্বস্ত করেন যে, গরীবুল্লাহ কিছু দিন পর অবশ্যই তাঁর পয়সা পেয়ে যাবেন। খালি হাতে গরীবুল্লাহ রেলগাড়িতে চড়ে সরাসরি সিলেট চলে যান। স্টেশনে নামার পর এক মস্ত বড় জমিদারের সাথে তাঁর দেখা হয়। জমিদার তাঁকে সাথে করে বাড়ি নিয়ে যান। তাঁকে একটি মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেওয়া হয়। ঐ মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে তিনি তৎকালীন ক্বারীয়ানা পাশ করেন। মাদ্রাসায় থাকা অবস্থায় একদিন রাতে ঘুমের মাঝে স্বপ্নে দেখেন পিতা তাঁকে আদেশ করছেন- ঘুম উঠে খালি পায়ে পশ্চিম দিকে হা্ঁটতে। বাবার আদেশ মত তিনি ঘুম থেকে উঠে পশ্চিমে হাঁটতে থাকেন। হঠাৎ একজন লোক তাঁর পরিচয় ও ঠিকানা জানতে চায়।গরীবুল্লাহ উত্তরে বলেন” আমি একজন মুসাফির, আমার কোন ঠিকানা নাই। ঐ লোকটি তাঁকে একটি আস্তানায় নিয়ে যায়, আর ঐ আস্তানাটই ছিল পীরে কামেল হজরত বালক শাহ,র।
আলাপান্তে বালক শাহ এ মুসাফিরকে তাঁর আস্তানায় থাকতে দেন। আস্তানায় থাকা অবস্থায় বালক শাহ বুঝতে পারেন গরীবুল্লাহ উত্তম চরিত্রের অধিকারী। তাঁর জিকির আসগার অনেক ভালো ছিল। অজু করা অবস্থায় একদিন গরীবুল্লাহ গভীরভাবে কাঁদতেছিলেন। পীর বালক শাহ তাঁর কান্নার কারণ অতি সহজেই বুঝতে পারেন। তিনি দেখলেন তাঁর দশ হাজার মুরিদানের মধ্যে গরীবুল্লাহই শ্রেষ্ঠ। গরীবুল্লাহ কেরামত নিবার যোগ্যতা অর্জন করেছেন। পীর বালকশাহ তাঁকে ৩টি কেরামত প্রদান করেন- যা (১)পরশ পাথর মুখে রাখলে ক্ষুধা লাগবে না ও ঘুম আসবে না।(২) রুমাল মাথায় রাখলে কেউ তাঁকে নদীতে ফেলতে পারবে না, ফেললে ও তিনি পানিতে ডুববেন না।(৩)খড়ম পায়ে নদীতে হাঁটলে ও ডুববেন না। এ তিনটি কেরামত দিয়ে বালকশাহ ইহলোক ত্যাগ করে চলে যান অনন্তলোকে।

ওফাত লাভের আগেই হজরত বালকশাহ গরীবুল্লাহকে সিলেট ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন। কারণ গরীবুল্লাহ কেরামত পাওয়ার কারণে সিলেটে তাঁর শত্রু দেখা দিয়েছিল। গরীবুল্লাহ সিলেট ছেড়ে পুনরায় চলে আসেন ঢাকায়। তবে কিছু কাজ বাকি ছিল। বালকশাহ বলেছিলেন, যে ব্যক্তি আমাকে তিনবার তোমার সাথে সাক্ষাৎ করতে পারবে সে ব্যক্তিই তোমার উপযুক্ত ওস্তাদ হতে পারবেন। উল্লেখ্য যে, বর্তমানে ঢাকায় পীর ইয়ামিনের মাজারের পাশে পীর বালকশাহের মাজার রয়েছে।সিলেট থেকে ঢাকায় এসে গরীবুল্লাহ পীর ইয়াসমিনের মাজারের আশেপাশে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরাফেরা করতে থাকেন। ঘটনার সৌভাগ্যক্রমে এখানে গরীবুল্লাহ দেখা পেয়ে যান জনৈক মৌলানা জাল শরীফের সাথে। বালকশাহকে তিনবার দেখানোর শর্তে গরীবুল্লাহ জাল শরীফের মুরিদ হন। গরীবুল্লাহর ইচ্ছা এবং মৌলানা জাল শরীফের প্রচেষ্টা সফল হয়। একে একে তিনবার জাল শরীফ বালকশাহকে দেখাতে সমর্থ হন। এমনি কিছুদিন গেলে মৌলানা বলেন, তুমি দেশে গিয়ে তরীকত প্রচার করতে পারো।
নরসিংদী জেলাধীন বর্তমান শিবপুর উপজেলার মাছিমপুর ইউনিয়নের ধানুয়া একটি অতি পরিচিত গ্ৰাম। এ গ্ৰামে শায়িত আছেন উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মহানায়ক শহীদ আসাদ। গ্ৰামের উত্তর পশ্চিমাংশে অভিজাত শ্রেণির মিয়াবাড়ি রয়েছে। এটি একটি খান্দানী পরিবার। ক্বারী বাড়ির জন্য মিয়াবাড়ির অনেক অবদান আছে বলেও মানুষ জেনে আসছে। মিয়াবাড়িতে লাল মৌলানা নামে একজন মৌলভী জায়গীর থেকে ছেলেমেয়েদের আরবি পড়াতেন। শুনা যায় ঐ মৌলভীর বাড়ি ছিল ভারতের কলকাতায়। তিনি ও আধ্যাত্বিক ধরণের লোক ছিলেন এবং এক সময় গরীবুল্লাহর পরিচিতি জানতেন এবং প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে গরীবুল্লাহর সাথে দেখা হয়েছিল তাঁর। দেখার প্রভাব পড়েছিল দুইজনের‌ই উপর। সম্ভবতঃ গরীবুল্লাহ তাঁর পরিচিত হ‌ওয়ার সুবাদে ধানুয়ায় আসার সুযোগ হয়েছিল।

ক্বারী গরীব‌উল্লাহর কেরামতিঃ লোকের মুখেমুখে গরীবুল্লাহর অনেক কেরামতির কথা শোনা যায়। একটি ঘটনাঃ তখন ঢাকায় বসবাসরত এক মহিলার সন্তান হয়ে হয়ে মারা যেতো। সন্তান রক্ষার জন্য ডাক্তার কবিরাজের নিকট ঘুরেটুরে ও কোন ফল হচ্ছিল না। লোকমুখে শুনে কারো মতে লাল মৌলানার ইশারায় ঐ মহিলা ক্বারী গরীব‌উল্লাহর স্মরণাপন্ন হয়ে দোয়া প্রার্থনা করেন। দোয়া করে গরীবুল্লাহ বলেন, এবার তোমার গর্ভে সন্তান এলে আমাকে জানিও। পরবর্তীতে মহান আল্লাহ পাকের দয়ায় ঐ মহিলা সন্তান সম্ভবা হয়ে ক্বারীকে অবহিত করেন। সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে ক্বারী তাঁর হাতের লাঠি দিয়ে আস্তে করে বাচ্চাকে আঘাত করেন। তিনি হাসতে হাসতে বলেন, এখন থেকে সন্তানের ব্যাপারে আল্লাহর রহমতে আর কোন চিন্তা করতে হবেনা। তিনি ঐ ভদ্র মহিলার পুত্র সন্তান দেশের নামীদামি মানুষ হবে বলে ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলেন। অনেকের মতে ঐ সন্তান কবি হয়েছিলেন। তাঁর নাম ছিল বিপ্লবী কবি বেনজীর আহমদ। এমন বহু কেরামতির কথা জানা যায় যা ক্বারী গরীব‌উল্লাহর দ্বারা সংগঠিত হয়েছে এ লেখায় উল্লেখ সম্ভব হলো না।
ক্বারী গরীব‌উল্লাহর শেষ জীবনঃ শেষ জীবনে এসে গরীবুল্লাহ সদা সর্বদাই আল্লাহর ধ্যানে কাটাতেন। একেবারে শেষ বয়সে এসে সাধারণতঃ কথাবার্তা তেমন বলতেন না। ক্রমাগত আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন থেকে থেকে দুর্বল হয়ে পড়েন। এমনিভাবে আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে তাঁর অসংখ্য মুরিদান রেখে মায়াময় এ পৃথিবী ছেড়ে পরলোকে চলে যান। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। জীবিত থাকতে তার কাছে অনেকে মুরিদ হয়েছিলেন। তিনি তাঁর ছেলেদের খেলাফত দিয়ে যান। অনেক কেরামতি ও ছেলেরা শিখেছিল। ছেলেদের কারিয়ানার যথেষ্ট গুনাগুণ ছিল। বর্তমানে গরীবুল্লাহর পথ ধরে রয়েছেন ক্বারী রহমতুল্লাহ,ক্বারী মনীর হোসেনসহ আর ও দুইএক জন। কিছুদিন পূর্বে ও ছিলেন ক্বারী শহীদুল্লাহ, ক্বারী সাফাতুল্লাহ। তারা গরীবুল্লাহর খেলাফত পেয়েছিলেন বলে জানা যায়। সাফাতুল্লাহর চেহারায় আধ্যাত্বিকতার স্পষ্ট ছাপ লক্ষ্য করা গিয়েছে।

ক্বারী গরীব‌উল্লাহর ধারাবাহিকতায় তাঁর উত্তরসুরীগণ বাপ দাদার আদলে প্রতি বছর ওরশ পালন করে থাকেন। এ বংশের মানুষ জন অতি সাদাসিদে জীবন যাপন করেন। সাধারণভাবে ওরশ করলে ও ওরশটি বৃহত্তর আকার ধারণ করে। ওরশকে লক্ষ্য করে তিনদিন ব্যাপী মেলার আয়োজন হয়। আশপাশের বাড়িসহ সমগ্ৰ এলাকায় ওরশ ও মেলার প্রভাব পড়ে। বর্তমান বছর ২০২২ সালে ক্বারী বাড়ির ওরশের ১৫৪তম বর্ষ অতি কান্ত হচ্ছে। এবারও এ ওরশে অনেক মুরিদান উপস্থিত হয়ে ওয়াজ নছিয়ত, জিকির আসগার করে পরম করুনাময় মহান আল্লাহতালার নৈকট্য লাভের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। সত্য, ন্যায় ও আদর্শের পথ তারা অনুসরণ করবে এমনিটি সকলের প্রত্যাশ। ক্বারী বাড়ির পূর্বসুরী মরহুম ক্বারী শহীদুল্লাহর দেওয়া তথ্যপত্র, এলাকার লোকমুখে শুনা এবং দীর্ঘ দিন দেখে এসেছি এমন তথ্যের ভিত্তিতে এ প্রবন্ধ প্রনয়ণ করা হয়েছে।

লেখকঃ সাবেক উপজেলা শিক্ষা অফিসার (টিইও)


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category