নূরুদ্দীন দরজী:
শিবপুরের ফজলু মাস্টার অথবা ফজলু মাস্টার সম্বোধনটি সমসাময়িকদের। আবার অসংখ্য ছাত্রছাত্রীদের তিনি ছিলেন শিক্ষক, অত্যন্ত প্রিয় শিক্ষক। যারা তাঁর সমবয়সী বন্ধুবান্ধব, সতীর্থ ও একান্ত আপন জন ছিলেন তারা ডাকতেন ফজলু মাস্টার নামে। এ,কে ফজলুর রব,ফজলু স্যার কারো কাছে ফজলু মাস্টার নরসিংদীর শিবপুরের এক কিংবদন্তি চুল্য শিক্ষক, শিক্ষক আদর্শের এক মূর্তপ্রতীক।শুধুই শিবপুর নয় তিনি সমগ্র বাংলাদেশ তথা বিশ্বের আদর্শ শিক্ষকগণের প্রেরণার উৎস ও কর্ণধার। শিক্ষকগণ মহান,তাঁরা মহীয়ান এবং বিশাল। বলা হয়ে থাকে “শিক্ষকের প্রভাব কখনো শেষ হয়না, আর এ কথাটি এমন আদর্শ শিক্ষকগণের জন্যই বুক ফুলিয়ে বলা সম্ভব। ফজলু স্যার ছিলেন ত্যাগ তিতিক্ষায় উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, কর্ম নিষ্ঠায় দূঢ়,উজ্জ্বলতায় দীপ্তমান এবং গণনার অপরিসীম। এমন সুপণ্ডিত ও সুমানুষকে নিয়ে কোন কিছু লিখা সত্যিই খুব কঠিন ও দূরূহ। ফজলু স্যার সম্পর্কে কিছু লিখার ধৃষ্টতা দেখাচ্ছি মাত্র। ভূলত্রুটি মার্জনীয়।
এ,কে ফজলুর রব,ফজলু স্যারের জন্ম শিবপুরের সুনামধন্য গ্ৰাম সৈয়দের গায়ে। পিতা মোহাম্মদ আলী এবং রত্নগর্ভা মা মরহুমা জোহরা খাতুন। তিনি ছাত্র জীবন সমাপন করে শিক্ষকতা পেশাকে বেছে নিয়েছিলেন। ছিলেন সাদাসিদে টাইপের মানুষ। তাঁকে দেখলে মনে হতো উদাসিন প্রকৃতির। চলাফেরা করতেন নিতান্তই সহজ সরল বেশভূষায়। তৎসময়ে বেশির ভাগ প্রচলিত লুঙ্গি পরতে পছন্দ করতেন। হাতে থাকতো একটি ছাতা। আবার চাদর ও তাঁর খুব প্রিয় ছিল। সামনাসামনে,শয়নে স্বপনে তাঁকে যেভাবেই চিন্তা করিনা কেন মনে হয় চাদরটি গায়েই রয়েছে। তাঁর চাদরের যেন অন্য নাম ফজলু স্যার। মুখ ভর্তি ছিল পরিপাটি দাড়ি। দাড়িতে তাকে একজন আদর্শিক সুপুরুষ মনে হতো অনায়াসেই। প্রতিদিন বাজার করতেন নিজ হাতে। কিনতেন টাটকা শাকসব্জি। পছন্দ সই বাজার করে দিনের আলোতেই হেঁটে হেটেই বাড়ি ফিরতেন। বাজার থেকে লাউ কাঁধে করে বাড়ি ফিরতে দেখেছি অনেকবার। রাতে বাড়ির বাইরে থাকা তাঁর পছন্দ ছিলনা। বাড়ির সরু মেঠোপথ থেকে শুরু করে থানা সদরের পথে হাটা দেখলে মনে হতো রাস্তাগুলো বুঝি তাঁর জন্য ধন্য হযেছে। এক দিক থেকে ধুমকেতুর মত উদয় হয়ে নিমিষেই অন্য দিকে মিলিয়ে যেতেন। মনে হতো বোধ হয় কিছুই দেখেন না -কিন্তু দেখতেন সব কিছুই। তাঁর চোখ দুটো বলতো তিনি সর্বদাই জাগরিত। সর্বক্ষেত্রেই মহান ফজলু স্যার ছিলেন যেন ভাসমান। শুধুই শ্রেণিকক্ষে নয় তিনি সবখানে সব জায়গায়ই ছিলেন শিক্ষক। রাস্তায় হাঁটাচলা নিয়ে ফজলু স্য্যারের রয়েছে অনেক স্মরণীয় উপাখ্যান।
ফজলু মাস্টারের হেঁটে চলার সময় যদি কোন ছাত্র সামনে পড়ে যেতো সে ছাত্রের হৃদকম্পন শুরু হতো স্বয়ংক্রিয় ভাবে। যদি কোন ভুল বা বেয়াদপি হয়ে যায় ভয়ে। একটি বিষয় বোধ হয় অনেকেরই মনে আছে যে,তখন অভ্যাসগত না হলেও সৌখিনতা বশতঃ অনেক ছাত্রই সিগারেট টানতো। সম্ভবত তখন প্রাণ হরণকারী তামাক এ দেশে বিড়িতে প্রমোশন হয়ে সিগারেট রুপে আত্ম প্রকাশ করেছিল। অনেক ছাত্র বিকেলে বের হয়ে সখ করে সিগারেট জ্বালিয়ে মুখে তুলতো। বলা যায় এটি অনেকটা ফ্যাশানে ছিল। দৈবক্রমে সিগারেট মুখে কোন ছাত্র ফজলু স্যারের সামনে পড়ে গেলে তার হার্টের পালসগুলো নড়বরে হয়ে যেতো। সিগারেট হাত থেকে কোথায় গিয়ে পড়েছে সে ছাত্র তা বলতে ও পারতো না। বুঝে নিতো স্যার বোধ হয় দেখেননি। বোধ হয় বাচাঁ গেল। ছাত্রটি কশ্মিন কালেও চিন্তা করতো না যে এর আর ও কিছু বাকি আছে। মনে হতো আগুনের ফুলকি পানিতে পড়ে নিভে গেছে। কিন্তু না। পরের দিন হঠাৎ শ্রেণিকক্ষের এক কর্ণারে গতকালে নিবে যাওয়া বারুদ শতগুন তেজস্বী হয়ে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠতো। ছাত্র-শিক্ষক মুখোমুখি হতেন। শিক্ষক জানতে চাইতেন,” তুমি গতকাল আমাকে দেখে আস্ত সিগারেট কেন ফেলে দিয়েছিলে? ঐ সিগারেটতো আমার বাবার নয়- তোমার বাবার পয়সায় কেনা ছিল! কোথায় শিখেছ এমনভাবে বাবার পয়সা নষ্ট করা ? ভয়ে ভয়ে ছাত্রটির চোখমুখ নীল হয়ে যেতো। নীতি আর নৈতিকতার বেড়াজালে মুখ বা ঠোঁট দিয়ে শব্দ নামের কোন কিছুই বের হতোনা। এক পক্ষীয় কুরুক্ষেত্রে পরিনত হতো শ্রেণিকক্ষ। শিক্ষক জানতে চাইতেন”,বলো, আরো কোন দিন এমন করবে কিনা? সুযোগ নিতে চেষ্টা করে অসহায়ের মত কাঁদতে কাঁদতে ছাত্রটি বলে ফেলতো, স্যার, জীবনে আর কোন দিনই সিগারেট খাবো না। ফলশ্রুতিতে দেখা যেতো সে ছাত্র চিরতরে ধুমপান ছেড়ে দিয়েছিল।
ফজলু মাস্টার অনেকটা রাগী ধরণের মানুষ ছিলেন। কিন্তু রাগ সব সময়ই ছিল ন্যায় ভিত্তিক। অন্যায় কিংবা আদর্শের পরিপন্থী যে কোন কাজের বিপক্ষে রুখে দাঁড়াতে কখনো কুন্ঠিত হতেন না। ১৯৭১ সালে আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তাঁকে নিয়ে নিকটাত্মীয় ও আপনজনেরা খুবই চিন্তিত ছিলেন। ভয় ছিল হানাদার পাকিস্তানী সেনাদের সাথে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন কি না। যুদ্ধের সময় ও তিনি স্বাধীন মানুষ হিসেবে বুক ফুলিয়ে চলাফেরা করতেন। হানাদারদের নৃশংসতা চরমে পৌছলে থানা সদরের আশপাশের গ্ৰামগুলো হতে নিরীহ সাধারণ মানুষকে কিছুটা নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নেওয়া হতো। কিন্তু তাঁকে বুঝানো কঠিন ছিল। অনেক বুঝিয়ে একদিন দুই মাইল দূরে শ্বশুর বাড়ি দত্তেরগাঁও পাঠানো হয়েছিল। ভয়ে নিজের বাপ দাদার বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র থাকা তাঁর একেবারেই সহৃ হচ্ছিল না। তিনি নিতান্তই মর্মাহত হয়ে পড়েছিলেন। অপমানের রাগে কারও সাথে কোন কথাই বলছিলেন না । সেদিন হঠাৎ করেই নিজের বাড়ি চলে এসেছিলেন। শ্বশুর বাড়ি কর্তৃক জামাই এর জন্য সকল আয়োজন বলতে গেলে নিষ্ফলে গিয়েছিল। সে রাতের অবস্থা ভয়াবহ হলেও করুনাময়ের দয়ায় আদর্শের পরাকাষ্ঠ মহান শিক্ষক ফজলু স্যারের কিছুই ক্ষতি হয়নি। তিনি চলেছেন নির্বিবাদে সকল ভয় ভীতি উপেক্ষা করে। ফজলু স্যারের জীবনে এমন বহু ঘটনা রয়েছে যা এলাকায় জনশ্রুতি হিসেবে এখনো বর্তমান,যা থাকবে আবহমানকাল। ক্ষুদ্র পরিসরে সে কথাগুলো লিখে শেষ করতে পারবো না।
শিবপুরের ঐতিহ্যবাহী লাখপুর শিমুলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে শুরু করে তাঁর পুরো শিক্ষকতা জীবন কেটেছে বর্তমানের শিবপুর পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ে। প্রথম দিকে সহকারী শিক্ষক এবং দীর্ঘ দিন প্রধান শিক্ষক। ফজলু স্যার ছিলেন পরশমণি সম শিক্ষক। ছাত্রদেথ জন্য একদিকে আতংক হলেও মানসে ছিলেন পরম সহযোগী অকৃত্রিম বন্ধু। এ মহান শিক্ষক জ্ঞান প্রদীপের ছোঁযায় শত সহস্র জীবন প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত হয়েছে। তাঁর হাজারো হাজারো ছাত্র জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে দেশের কল্যাণসহ এলাকার মুখ উজ্জ্বল করেছে- অনেকেই হয়েছে অনেক বড়, নামী ও দামী। আবার অনেকে পেয়েছে বিশ্ব পরিচিতি ও। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকজন ছাত্রের মধ্যে শিবপুর আসনের সাবেক এমপি শহীদ রবিউল আউয়াল খান কিরণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক,বহুদেশ ভ্রমনকারী, লেখক ও গবেষক এবং সর্বশেষ বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সুদক্ষ চেয়ারম্যান মরহুম ড.আসাদুজ্জামান। জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর জসীম উদ্দিন আহম্মেদ ফজলু স্যারের শিক্ষকতা জীবনের উর্বর ফসল। আর ও অনেক ছাত্রের মধ্যে শিবপুর শহীদ আসাদ কলেজিয়েট হাইস্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ,সফল চেয়ারম্যান, ও সফল পিতা আবুল হারিস রিকাবদার কালামিয়া।
এ নশ্বর পৃথিবীতে ফজলু স্যার আর নেই। পরপারের ডাকে সাড়া দিয়ে, শত সহস্র মানুষকে অশ্রু জলে ভাসিয়ে তিনি চলে গেছেন ১৯৮৪ সালের ২৯ অক্টোবর। তাঁর মৃত্যুতে আকাশ থেকে খসে পড়েছে একটি ঝলমল জ্যোতিময় নক্ষত্র। তিনি চলে গেছেন চিরতরে ভক্ত অনুরাগী ও তাঁর স্নেহের ছাত্রদের দৃষ্টির অন্তরালে। কিন্তু তাঁকে চর্মচক্ষে দেখা না গেলে ও তিনি বিরাজমান এলাকার সকলের মানসচক্ষে।
শিক্ষকগণ আছেন, ছিলেন এবং থাকবেন অনন্তকাল ধরে। শ্রদ্ধেয় শিক্ষকগণের কারণেই মানব সভ্যতার আজ এত উন্নতি, শিক্ষা ও সংস্কৃতির হয়েছে ব্যাপক প্রসার এবং বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি এগিয়েছে অনেক দূর। শিক্ষক নেই যেখানে আজ ও অন্ধকার সেখানে। যদি উদাহরণ দেই, পৃথিবীতে এখনো এমন অনেক গুহা,বনজঙ্গল আছে যেখানে মানুষকে বসবাস করতে হচ্ছে পশুদের সহযাত্রী হয়ে। কারণ একটাই,ওই সব বনে জংগল ও গুহায় কোন শিক্ষক নেই, বিজ্ঞানী নেই, তথাকার মানুষকে গড়ে তোলার সৎ উপদেশ দেওয়ার ও সভ্যতার আওতায় আনার। যেদিন তারা শিক্ষক পাবে ও শিক্ষার সংস্পর্শে আসবে তারা অবশ্যই সভ্য জগতের মানুষ হয়ে উঠবে। একমাত্র শিক্ষকই দিতে পারেন তাদের সভ্যতার ছোঁয়া।
রেখে যাওয়া প্রিয় ছাত্রদের শয়নে, নিশির স্বপনে দিবা জাগরণে যে ফজলু মাস্টার, ফজলু স্যার রয়েছেন তাঁর পরলোক গত আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। ভবিষ্যতে সুযোগ পেলে তাঁর রেখে যাওয়া বিভিন্ন দিক নিয়ে আর ও লিখবো এ প্রত্যাশায় আজকে এখানেই শেষ করছি।
লেখকঃ সাবেক উপজেলা শিক্ষা অফিসার (টিইও)