নূরুদ্দীন দরজী
১৯৫২ সালে বাংলা ভাষার উপর আঘাত এলে সমগ্ৰ বাঙালি জাতি একতাবদ্ধ হয়ে যায়। এর পূর্বে কখনো এমন একতাবদ্ধ হতে পারেনি। পাক ভারত উপমহাদেশের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বিদেশি শোষণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে এখানকার মানুষ অনেক সংগ্ৰাম করেছে, রক্ত ঝরিয়েছে। কিন্তু বাঙালিদের মত লড়াই ও সংগ্রাম কেউ করতে পারেনি,বিপুল রক্তও ঝরায়নি । ইংরেজদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি বিদ্রোহ হয়েছে বাংলার মাটিতে ,করেছে বাংলার মানুষ। বাংলা মায়ের অসংখ্য সন্তান অকাতরে জীবন উৎসর্গ করেছে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্ৰামে। কিন্তু নিজেদের অধিকার আদায় করতে পারেনি ৫২- এর আগে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের হাত থেকে পাকিস্তান সৃষ্টি হলে ও পূর্ব বাংলার মানুষ অত্যাচার নির্যাতন থেকে রেহাই পায়নি। দুদন্ড প্রতাবে পাকিস্তানীরা আমাদের দেশ তাদের শোষণের নব্য ক্ষেত্র বানায়। আমরা হই তাদের সম্পদ লুটের কাঁচামাল। শোষণের পথ পরিস্কার করার জন্য হানাদাররা আমাদের ভাষার উপর হস্তক্ষেপ করে। মায়ের ভাষা বাংলা কেড়ে নিতে চায়। বাঙালিরা বিদ্রোহী হয়ে উঠে। বিদ্রোহটা শুরু হয়েছিলো ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চে। বলতে গেলে সংঘর্ষের সূচনা। ১৯৫২ সালে এসে তাদের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ আমাদের পাকিস্তানী বানিয়ে উর্দু ভাষা আমাদের উপর চাপিয়ে দিবার ঘোষনা করে। কিন্তু বাঙালিরা তা মেনে নেয়নি। আমাদের ছেলেরা ঘোষনার তীব্র প্রতিবাদ করে। তারা ছাত্রদের উপর গুলি চালায়। রক্তপাত ঘটে। শহীদ হয় বাংলা মায়ের কোমল ছেলেরা। বিষয়টি সমগ্ৰ বাঙালির মর্মে আঘাত লাগে, তারা সবাই একতাবদ্ধ হয়। হানাদের হাত থেকে রক্তের বিনিময়ে বাংলা ভাষাকে রক্ষা করে। ভাষার জন্য সেদিন বাঙালি যেভাবে একতাবদ্ধ হয়েছিলো সে একতার পথ ধরে পরবর্তী সকল সংগ্ৰামে তারা বিজয়ী হয়। এ জন্যই আমরা বলি বায়ান্নের আগে বাঙালি এমন একতাবদ্ধ আর কখনো হতে পারেনি।
সে সূত্রে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে এ দেশের মানুষ বিজয়ী হয় – যদিও ষড়যন্ত্র করে আমাদেরকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ১৯৬২- তে শিক্ষায় আমাদের পিছিয়ে দিতে যে শিক্ষা কমিশন গঠন করে তার বিরুদ্ধেও বাংলার মানুষ সংগ্ৰাম করে জয়ী হয়। ১৯৬৬ সালে এ দেশের মানুষের স্বাধীকার আদায়ের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬- দফা কর্মসূচি ঘোষনা করেন। ৬- দফার পথে হেঁটে হেঁটে আমরা অনেক দূর অগ্ৰসর হই। ১৯৬৯ সালে ছাত্র সমাজের ১১- দফা দাবীও সাফল্যের পথ ধরে। আসে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মত মহা অভ্যুত্থান। বাংলার মানুষের মনে বিস্ফোরণ সৃষ্টি হয়। জীবন বাজি রেখে তারা এগিয়ে যায়। ৭১- এর ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু সকলকে স্বাধীনতার উদাত্ত আহবান জানান। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়ে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করে বেনিয়া পাষান্ড পাকিস্তানীদের পরাজিত করে বিজয়ী হয় এ দেশের মানুষ। শোষণের চির অবসান করে আমরা অর্জন করি লাল সবুজের পতাকা, স্বাধীন ভূখণ্ড ও স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র।
লেখার অনেক কিছু থাকলেও আর বড় করতে চাইনা। এ লেখাটিতে স্পষ্ট করে বক্তব্য হলো যে, ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বাংলার মানুষ যদি একতাবদ্ধ না হতে পারতো তাহলে হয়তোবা আরো লাঞ্চনা, বঞ্চনা,শোষণ ও বিদেশি নির্যাতনের স্বীকার আমরা হতে থাকতাম। সেদিন যে সকল অকুতোভয় বীর বাঙালি,ছাত্র জনতা জীবন উৎসর্গ করে বাংলার মানুষের মুক্তির পথ দেখিয়ে গেছেন তাঁদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে শেষ করছি।
লেখকঃ সাবেক উপজেলা শিক্ষা অফিসার।